আমাদের শিশু শিক্ষার ভেতরের ভুবন

০৫ জানুয়ারি ২০২০, ০৫:৪৬ পিএম | আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৩১ এএম


আমাদের শিশু শিক্ষার ভেতরের ভুবন

 

                                                            ---মহসিন খোন্দকার---

নরসিংদী শহরে বেশ কয়েকটি কারাগার স্কুল আছে, তাদের মূল উদ্দেশ্য হলো ছলেবলে অর্থ হাতানো, শিক্ষা জিম্মি করে সীমাহীন অর্থ শোষণ, কচি শিক্ষার্থীদেরকে সীমাহীন মানসিক যন্ত্রণা দেওয়া, তাদের কচি বোধভাবনা নিয়ে ধস্তাধস্তি করা,কচি কাঁঠাল অসময়ে পাকিয়ে ফেলা, অল্প বয়সে ইঁচড়ে পাকা বানানো। এখানে ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের নিজস্ব কোনো ইচ্ছে নেই, নিজস্ব কোনো চিন্তা ভাবনা নেই, চাপিয়ে দেওয়া এক অতি অদ্ভুত ভারী ভাবনা তাদের কোমল মস্তিষ্কে ঠেসে দিয়ে তাদেরকে বিকলাঙ্গ বানানো হচ্ছে। তাদের কোনো মাঠ নেই, কোনো খেলাধুলা নেই, কোনো বিনোদন নেই, কোনো শৈশব নেই, দুরন্তপনা নেই, এমনকি মুক্ত বাতাসটুকুও পাচ্ছে না তারা।

খামারি পদ্ধতিতে একটি দশফুট বাই দশফুট দমবদ্ধ কক্ষে এক'শ জন অবোধ বাচ্চা ঠেসে দিয়ে তাদেরকে দেয়া হচ্ছে অতি উচ্চভিটামিন যুক্ত শিক্ষা। তারা হাসফাস করছে, তারা ছটফট করছে কিন্তু মুক্তি নেই। প্রায় প্রতিদিন দেখি ঘুমভরা চোখে ক্লান্তপ্রাণে ওরা ছুটছে, ওদের কাঁধে বইয়ের বোঝা, হাতে টিফিন বক্স, ছাতা,আরো ব্যাগ, আরো শিক্ষারসদ। তারা শিক্ষাভারে বেঁকে যাচ্ছে, হাপাচ্ছে। তাদের দেখে মনে হচ্ছে সব কিছু নিয়ে তারা যেনো এভারেস্ট জয় করতে যাচ্ছে। আমরা তাদেরকে এক কঠিন দ্বান্দ্বিক পথে ঠেলে দিচ্ছি। আমরা ভাবছি ওরা বিদ্যার জাহাজ, ভারী ভারী ভাবনা চাপিয়ে দিলেই ওরা হন হন করে বয়ে নিয়ে যাবে। এক কৃত্রিম অন্ধ প্রতিযোগিতা আমাদেরকে প্রবল তাড়িত করছে। বাচ্চাদেরকে নিয়ে আমরা জুয়ায় মেতে ওঠেছি। শত সহস্র কচি মাথা যন্ত্রণার ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে আমরা ভাবছি তারা সব উদ্ধার করছে। মনে হচ্ছে  তারা যেনো জন্মগ্রহণই করেছে শিক্ষাদাস হওয়ার জন্যে অথবা পরের চিন্তা ভাবনা বহন করার জন্যে।

নরসিংদী সহ সারা দেশে কিছু কর্পোরেট মাথা বিদ্যাকে শতভাগ ব্যবসায় পরিণত করেছেন। এ যেনো এক আলাদীনের চেরাগ--ঘষা দিলেই বেরিয়ে আসে ঝকঝকে মুদ্রা। তারা নতুন শ্লোগানও বানিয়েছে। টাকা দাও শিক্ষা নাও। আগে আমাদের দেশে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি চালু ছিল (কাবিখা)। এখন কিছু অতি চালাক, মুদ্রালোভী মাফিয়া বের করেছে, টাকার বিনিময়ে বিদ্যাদান কর্মসূচি (টাবিবি)। বাহ! কী মওকা! কী মকছুদ!

বর্তমানে নরসিংদী শহরের মোড়ে মোড়ে শিশুকারাগার (তথাকথিত স্কুল)। এসব স্কুলের ফটকে দুই তিনজন দারোয়ান, প্রায় সময়ই ফটক বন্ধ থাকে, জানালা বন্ধ থাকে, যেনো এক অদ্ভুত অন্ধকূপ অথবা মামদুভূতের বাড়ি। তারা বাইরের আলো বাতাস পায়না, প্রকৃতির  সংস্পর্শ পায়না, ইটসুরকীর এক আজব খাঁচায় বসে বসে চিরিয়ার মতো বিরস বিদ্যা হজম করে। আমার মতে যে কক্ষের জানালা দিয়ে দূরের আকাশ দেখা যায়না, দূরের নদী দেখা যায়না, দূরের সবুজ দেখা যায়না, বিশাল মাঠ নেই, খেলাধুলার সুযোগ নেই, আনন্দ করার উপাদান নেই সেটা কোনো শিশুদের স্কুলনা। সেটা হলো কারাগার। আমাদের শহরে প্রায় সব স্কুলই শিশুকারাগার। চালাকরা স্কুলের নাম দেয় "শিশুস্বর্গ" আর তা তৈরি করে কারাগারের আদলে। এক'শ বাই বিশ ফুট স্কয়ারের একটি ঘরে এক হাজার শিশু। এটি কী করে শিশুস্বর্গ হয়?

শহরে একটি পান-বিড়ির দোকান খুলতে লাইসেন্স লাগে কিন্তু শিশুদের একটি স্কুল শুরু করতে তেমন কিছুই লাগেনা। নরসিংদী শহরে চার-পাঁচ বছর আগে যে কক্ষ গুলোর কপালে লেখা দেখেছিলাম "অমুক কোচিং সেন্টার তমুক কোচিং সেন্টার"এখন দেখছি "অমুক স্কুল তমুক স্কুল"। বাহ! কত সহজ। কোনো অপারেশন ছাড়াই এই দেশে ছাগলকে হরিণ বানানো যায়, গরুকে গুরু বানানো যায়। শুধু ওপরের চামড়া বদলে ফেললেই হলো, ছাগল রাতারাতি হরিণ হয়ে যায়। দু'চারটি খুপড়ি ঘর, দশ-বারো জোড়া বেঞ্চ, সাত-আট জন বেকার জড়ো হয়ে শুরু করে দিলেন স্কুল। তাদের শিক্ষাদানের কোনো দর্শন নেই, পদ্ধতি নেই, পূর্বজ্ঞান নেই, পেডাগজি জানা নেই তবু ধুমছে শিশুশিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন। আর তাদের আধুনিক প্রচার প্রোপাগান্ডার ভাষা দেখে মনে হয় তারা শিশুদের জটিল-কুটিল বিদ্যায় ভাসিয়ে দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট পারঙ্গম। বিচিত্র বাহারি বুলি, অতি উর্বর ভাষায় বিদ্যাদানের কথা-বার্তা শুনলে মনে হবে তারা স্কুল খুলেননি--খুলেছেন মুখরোচক পণ্যের দোকান।

 অন্যদিকে হন্যে হয়ে সবাই ছুটছে জিপিএ-৫ এর দিকে। এ যেনো এক অত্যাবশ্যক অক্সিজেন, এ ছাড়া যেনো সবাই মারা যাবে। সবার একই কথা, একই দাবী, তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই। অর্থাৎ মাথা নষ্ট হোক, জীবন চলে যাক, তবু জিপিএ-৫ চাই। মাথা যাক, তবু মাথা নোয়াবো না। এ এক অদ্ভুত বোধ ভাবনা যেনো জেঁকে বসেছে আমাদের অতি আধুনিক অভিভাবকদের মাথা মগজে। আমরা বুঝতে চাইনা, আমরা গোলাপ চারা লাগাতে পারি, যত্ন নিতে পারি, পরিচর্যা করতে পারি, কিন্তু নিজ হাতে গোলাপ ফোটাতে পারিনা। ফুল ফুটবে স্বমহিমায়। কিন্তু আমরা নির্বোধের মতো নিজ হাতে ফুল ফোটাতে গিয়ে ফুলের  নরোম পাপড়ি ভেঙ্গে ফেলছি,পরাগ নষ্ট করছি। শিশুদেরকে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলছি। পাথর রাষ্ট্রের বোধদয় হোক।

লেখক: কবি ও লেখক


বিভাগ : মতামত


এই বিভাগের আরও