পলাশের ডাঙ্গায় একাধিক অবৈধ ইটভাটা: ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষতি

১১ ডিসেম্বর ২০১৭, ০৬:০০ এএম | আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১২:২৭ এএম


পলাশের ডাঙ্গায় একাধিক অবৈধ ইটভাটা: ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষতি
নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী কমপক্ষে ৫০টি পরিবার বসবাস করে এমন আবাসিক এলাকার এক কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা নির্মাণ করা নিষিদ্ধ। অথচ পাঁচ সহ¯্রাধিক পরিবার বসবাস করে এমন একটি এলাকার ভেতরেই গড়ে উঠেছে চারটি অবৈধ ইটভাটা। পলাশ উপজেলার ডাঙ্গা ইউনিয়নের এসব ইটভাটা থেকে নির্গত ধোঁয়ার কারণে একদিকে যেমন ফসলি জমির ক্ষতি হচ্ছে, অন্যদিকে দূষণের শিকার হয়ে দুর্বিষহ দিন কাটাচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র এবং জেলা প্রশাসকের অনুমতি না নিয়েই স্থাপন করা হয়েছে ইটভাটাগুলো। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে একাধিকবার ভাটাগুলো উচ্ছেদে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হলেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এসব ইটভাটা বন্ধ করে উচ্ছেদের নির্দেশনা দেওয়ার দুই বছর পেরিয়ে গেলেও বাস্তবে এসব নির্দেশনার কোনো কার্যকর নেই। জনবহুল আবাসিক এলাকার ভেতরে এসব ভাটায় দিনের পর দিন ইট পুড়িয়ে যাওয়ায় নাকাল স্থানীয় বাসিন্দারা। সম্প্রতি ডাঙ্গা ইউনিয়নের সান্তানপাড়া ঘুরে দেখা যায়, এই গ্রামের জনবহুল আবাসিক এলাকার ভেতরেই পাশাপাশি গড়ে উঠেছে চারটি ইটভাটা। একটি থেকে অন্যটির দূরত্ব সর্বোচ্চ ৫০০ গজ। আর, সবগুলো ভাটার ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছে আবাসিক এলাকার ঘরে ঘরে। জানা গেছে, ২০১৫ সালের ২ জুন এখানকার তিনটি অবৈধ ইটভাটা বন্ধ এবং উচ্ছেদ করার নির্দেশ দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর। নরসিংদী জেলা কার্যালয়ের সিনিয়র কেমিস্ট বরাবর জারিকৃত ওই নির্দেশনায় তিনটি ইটভাটাকে পরিবেশগত দূষণের দায়ে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মো. তৌফিকুল আরিফ স্বাক্ষরিত ওই নির্দেশনায় এম এস এম ফারুক ট্রেডার্স, এইচ আর বি ট্রেডার্স এবং এম আর বি ট্রেডার্স নামক তিনটি ইটভাটা পরিবেশগত ছাড়পত্রবিহীন ইটভাটার কার্যক্রম পরিচালনা করছে বলে উল্লেখ করা হয়। আদেশ জারির পরবর্তী ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে ভাটাগুলো বন্ধ করতে বলা হয়। এমনকি এই তিনটি ইটভাটার ক্ষেত্রে পরিবেশগত ছাড়পত্র বাতিলসহ জেলা প্রশাসক কর্তৃক লাইসেন্স ইস্যু করা হয়ে থাকলে সেটি বাতিলের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে নরসিংদী জেলা প্রশাসককে চিঠি দিতেও নির্দেশনা ছিলো ওই আদেশে। এই আদেশ জারির পরেও ইটভাটাগুলো নিষিদ্ধ এলাকায় থেকে কার্যক্রম চালু রাখলে স্থানীয় জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে নির্দেশ দিয়েছিলো পরিবেশ অধিদপ্তর। ওই আদেশ জারির প্রায় আড়াই বছর পর সম্প্রতি এক বিকেলে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, সবগুলো ভাটায় প্রকাশ্যেই পোড়ানো হচ্ছে ইট। এ সময় কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে যাচ্ছিলো সেখানকার আকাশ। স্থানীয় ডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাবেরুল হাই জানান, আমার কাছে ট্রেড লাইসেন্স নিতে আসলে আমি ফিরিয়ে দেই। কারণ, জনবহুল ও আবাসিক এলাকায় ইটভাটা স্থাপন আইনে নিষিদ্ধ। ওরা আইন অমান্য করে ভাটা স্থাপন করে ইট পুড়িয়ে যাচ্ছে। এতে মানুষের চরম ক্ষতি হচ্ছে। প্রশাসনের উচিত অভিযান চালিয়ে এসব অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদ করে দেওয়া। উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, ডাঙ্গার বিভিন্ন এলাকায় যেসব ইটভাটা গড়ে উঠেছে, সবগুলোই কৃষিজমিতে। এসব জমিতে একসময় ভালো ফলন হতো। কৃষকেরা এখন চরম ক্ষতিগ্রস্ত। একদিকে যেমন ভাটার কারণে কৃষিজমি কমেছে, অন্যদিকে যেগুলোয় এখনও চাষ হয়, সেগুলোতে ভাটার ইট পোড়ানো ধোঁয়ার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত। সান্তানপাড়ার আয়নাল মিয়া জানান, ঘর থেকে বাইরে পা দিলেই মনে হয়, ইটের ধোঁয়ায় যেন পেট ভরে গেলো। সারাক্ষণ চোখ জ্বলে। মাথা ব্যাথা করে। ’ ভিরিন্দা গ্রামের আনোয়ার হোসেন, শফিক মিয়া, জালাল, সালামসহ এলাকাবাসী জানান, একসময় এলাকার গাছে গাছে নানা রকম ফলের দেখা যেতো। ইটভাটার ধোঁয়ার কারণে এখন কিছুই হয় না। মানুষের জীবনযাপন চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্করা ইটভাটার ধোঁয়ায় নানাভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। শুধুমাত্র সান্তানপাড়া-ভিরিন্দা গ্রাম নয়, আশপাশের খিলপাড়া, হাসানহাটা, জয়নগর, তালতলা, গালিমপুর এলাকায়ও অবৈধভাবে আইন অমান্য করে গড়ে উঠেছে প্রায় অর্ধশত ইটভাটা। এসব ভাটার ধোঁয়া আর আগুনের তাপে ডাঙ্গা ইউনিয়নের কয়েকশ’ বিঘার ফসল ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে। নষ্ট হচ্ছে ধান ও ফলের গাছ। জানা গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামবাসী নাকাল হয়ে টিকতে না পেরে মাঝে মধ্যে প্রতিবাদ করতে যান। ইটভাটার কারণে তাদের জনজীবন হুমকির মুখে পড়ছে, এমন কথা জানালে ভাটা মালিকেরা উল্টো তাদেরকেই কড়াভাবে শাসিয়ে দেয়। গ্রামবাসীকে তারা জানায়, সরকার লাইসেন্স না দিলে কি ইটভাটা বন্ধ থাকবে? ক্ষমতা থাকলে লাইসেন্স ছাড়াও ইটভাটা চলে। প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই আমরা ইটভাটা চালাই।  বলেও হুমকি দিচ্ছে ইটভাটার লোকজন। এম এস এম ফারুক ট্রেডার্সের সত্ত্বাধিকারী ফারুকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, অবৈধভাবে ইটভাটা অনেকেই চালায়। অনেকে সিটি কর্পোরেশনের ভেতরেও চালাচ্ছে। আমিও সেভাবে চালাচ্ছি। পরিবেশ অধিদপ্তরের অবৈধ ঘোষণার সেই নির্দেশনার পরও কিভাবে আবাসিক এলাকায় ইটভাটা চালাচ্ছেন এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এভাবে ফোনে কথা বলা যায় না। আপনি সাক্ষাতে আসেন, কথা বলবো। ডাঙ্গা ইউনিয়নের আরেকটি অবৈধ ইটভাটা মুগ্ধ ট্রেডার্সের সত্ত্বাধিকারী মোরশেদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। লাইসেন্স ছাড়া ইটভাটা চালানো যায় কি-না জানতে চাইলে নরসিংদী জেলা প্রশাসক সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, এটি কোনভাবেই সম্ভব না। ইটভাটা চালাতে হলে অবশ্যই লাইসেন্স লাগবে। পাশাপাশি এ সংক্রান্ত আইন মেনেই ইটভাটা চালাতে হবে। আইন অমান্য করে কেউ ইটভাটা চালালে আমরা অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। ডাঙ্গা ইউনিয়নের অবৈধ ইটভাটাগুলোর বিষয় তুলে ধরলে তিনি বলেন, অতি দ্রুতই অভিযান চালিয়ে ওইসব ইটভাটা বন্ধ করে দেওয়া হবে।


এই বিভাগের আরও