ভালো কাজ মানে সুন্দর পৃথিবী:  ড.মশিউর রহমান মৃধা

৩০ জানুয়ারি ২০১৯, ১০:৪৬ এএম | আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:১৬ পিএম


ভালো কাজ মানে সুন্দর পৃথিবী:  ড.মশিউর রহমান মৃধা

বোধ করি, পৃথিবীতে আগমনের হেতু কাজ করা এবং ভালো কাজ করা। মহৎ মানুষ, ভালো মানুষ, উন্নত মানুষ- এসব নির্ধারণের একমাত্র মানদ- ভালো কাজ। জীবন আলস্যের ভেতর একেবারেই নিষ্ক্রিয়, অর্থহীন। জীবনে কাজ না করা মানে জেলে বন্দী থাকা, কাজ না করা মানে হাসপাতালের বিছানায় রুগী হয়ে শুয়ে থাকা। জীবনকে বিবেচক, সুন্দর, উদার ও আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য ভালো কাজ অপরিহার্য। ভালো কাজ মানে যা দিয়ে পৃথিবীর কল্যাণ হয়, মানুষের মঙ্গল হয়।

কাজ করা এবং কাজ না করার মধ্যেই মানুষের যতো সুখ-অসুখ। আবার কাজকে শুধুমাত্র কাজের নির্দিষ্ট সীমারেখায়সীমাবদ্ধ রাখার মানেও আনন্দময় জীবন নয়। যারা মনে করে প্রতিদিন নিয়ম মাফিক কাজ তাদের দায়, তারা কাজের আনন্দ অনুভব করে না। যারা কাজের নামে একঘেয়েমির ভেতর জীবন কাটাচ্ছে তারা জীবনের অশেষ সৌন্দর্য ও অনন্য রূপের নাগাল পায় না। কাজ মানে আনন্দ। কাজ মানে নিত্যদিনের বিনোদন। কাজ মানে স্বপ্নময়, আনন্দময় বিষয় আশয়।

প্রতিদিন অপার বিস্ময়ে অবাক হওয়া জরুরি। জীবন জগত কতোটা আকষর্ণীয় তা অনুধাবন করা অপরিহার্য। চারিপাশে অসুন্দর দেখা, কুৎসিত দেখা কোনো কাজের কাজ নয়। আবার আত্মকেন্দ্রিক মানুষেরা নিজেদের নিয়ে নিরতিশয় ব্যস্ত থাকার কারণে পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ-বর্ণ-ছন্দ অনুভব করতে পারে না। মানুষের মাঝখান থেকেই মানুষ সেরা হয়, সফল হয়, কৃতিত্বের অধিকারী হয়। আবার মানুষের মাঝখান থেকেই মানুষ নিগৃহীত হয়, হয় অপাংক্তেয়। কোনো মানুষ অন্যের শ্রদ্ধা ভালোবাসায় হয় সিক্ত আবার কোনো মানুষ অবাঞ্চিত। এসবই মানুষের দায়। ভালো-মন্দ সকল কাজের জন্যই ফলাফল রয়েছে। কর্মের ফলাফল ভোগ করছে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুস্কর। কে, কোন ফলাফল ভোগ করবে তা একান্তই সেই মানুষের কাজের উপর নির্ভর করে। এর জন্য নিয়তি, প্রকৃতি কিংবা স্রষ্টাকে দায়ী করা অর্থহীন।

কোনো এক অদৃশ্য কারণে অধিকাংশ মানুষ নিজেদের অসুখী ভাবতে পছন্দ করে। এক জীবনের চাওয়া পাওয়ার মানদ-ে মানুষ সুখ-অসুখের বিচার করে থাকে। চাওয়া-পাওয়া বিচার্য বিষয় হতে পারে না। মানুষ নিজেকে, পরিবারকে, সমাজকে, রাষ্ট্রকে কতোটুকু উজার করে দিতে পারে, পেরেছে সেটি আসলে বিবেচ্য বিষয়। জীবন শুধু নিজের ইচ্ছায় পরিচালিত হবার বিষয়ও নয়। পরিবেশ, পারিপার্শ্বিকতা এবং অন্য মানুষদেরকে জীবনের অনুষঙ্গ হিসেবে মেনে নেয়া কিংবা মানিয়ে নেয়া জরুরি। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এবং বিশ্বের জন্য একজীবনে ধ্যান-তপস্যা-সাধনা অত্যাবশ্যক। বাধাহীন, প্রতিকূলতাবিহীন জীবন অতিক্রম করার নাম সার্থকতা নয়। জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবেলা করার নাম সার্থক জনম।

ব্যক্তিগত পূর্ণতা এবং সফলতাই আসল কথা নয়। অন্যদিকে না পাওয়ার বেদনাতলে মানুষ পূর্ণতা, সফলতাকে গুলিয়ে ফেলে। মানুষ জানে না জীবনের অগোচরে অন্তরালে কতো সফলতা লুকিয়ে আছে। অনেক মানুষ কুৎসিত, অনাচার, অসুন্দরকে পৃথিবীর প্রকৃত রূপ মনে করে। আসলে পৃথিবী অপরূপ নয়নাভিরাম সৌন্দর্যে ভরপুর। অনেক মানুষ দৃশ্যমান এবং বাহ্যিক বিষয়কে বড় করে দেখে। কিন্তু প্রকৃত সৌন্দর্য অবলোকনকারী অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখে। আসলে সৌন্দর্য মনের চোখ দিয়ে দেখতে হয়। সৌন্দর্যবোধই মানুষের মনে কাজের আগ্রহ সৃষ্টি করে, মানুষকে আশার বাসায় নিয়ে যায়।

জীবন যতো প্রসারিত, ততো সুন্দর। জীবনের বিশালতায় অসীম আনন্দ। জীবনের উদারতায় রয়েছে স্বপ্নময় স্পর্শ। হতাশাকে জীবনের কোনো অধ্যায়ে ঠাঁই দেয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। হতাশা দুর্বল চিত্তের লক্ষণ। হতাশাবাদীকে ব্যর্থতা অক্টোপাশের মতো আকড়ে ধরে। আশাবাদী জেগে থাকে, ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেয়। পরবর্তী সফলতার দ্বার উন্মোচন করে। সকলেই জানে দিনের শেষ প্রান্তে সূর্য ডুবে যায়, অন্ধকার নেমে আসে কিন্তু অনেক মানুষ দমে যায় না। সলতের আলোতে, মোমের আলোতে অর্থপূর্ণ জীবনের আয়োজন করে। পুনরায় সূর্যের বিশালতায় ফিরে যায়। আসলে অন্ধকার দূর করার মহৌষধ জ্ঞান, সৃষ্টিশীলতা। পৃথিবীর বিবর্তন বিকাশ উন্নয়নে অর্থপূর্ণ কর্মের ভিত্তি জ্ঞান। জ্ঞানভিত্তিক কাজ শব্দের চেয়েও দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলে। জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত যে কোনো কাজ মিহি মসৃণ। জ্ঞানের দ্বারা সম্পাদিত কাজ মঙ্গলালোকে আলোকিত।

বয়স বাড়ে মানুষের মধ্যে হাহাকার বাড়ে। মানুষ চূড়ান্ত হতাশার গহ্বরে নিমজ্জিত হয়। কেমন যেন হায় আফসোস। হায়রে! বুড়ো হয়ে যাচ্ছি, মরে যাচ্ছি। অথচ মহাকালের চিরন্তন সত্য সকল মানুষ মৃত্যুদ- মাথায় নিয়ে এসেছে। জীবনে আর কোনো ঘটনা ঘটুক আর নাই ঘটুক মৃত্যু অবধারিত। সুতরাং মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার কোনো সুযোগ নাই। খুব সহজ কথায় একটি উদাহরণ দেয়া যাক। কেউ একজন এক বৃদ্ধের কাছে কুশল জানতে চাইলো- কেমন আছেন? বৃদ্ধের উত্তর-আর বলবেন না কাজ করতে করতে বুড়ো হয়ে গেলাম। তখন প্রশ্নকারীর উত্তর যদি এমন হয়- কাজ না করলেও হতেন। বুড়ো হয়ে যাবার সাথে কাজের সম্পর্ক নাই, এটা রীতি, নিয়ম। বরং ভালো কাজই মানুষকে বুড়ো হতে দেয় না। ভালো কাজ মৃত্যুর কাছে হার মানে না। পৃথিবীতে অনেক স্মরণীয় বরণীয় মহাজন রয়েছেন যারা পৃথিবীকে আকর্ষণীয় করেছেন, বসবাস উপযোগী করেছেন, নান্দনিক করেছেন। যারা নির্মাণের কারিগর, সভ্যতার বিকাশ, পরিবর্তনের অগ্রদূত, তাদের উদ্দেশ্যে এই পৃথিবী প্রতিদিন শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করে। তারা জন্ম জন্মান্তরের বরপুত্র।

বয়স বাড়লে বরং জীবনের পূর্ণতা পায়। নানা রকম সুস্বাদু ফল পাকার জন্য মানুষের যেমন অধির আগ্রহ ঠিক তেমনি। এসময় দায়িত্ববোধ বেড়ে যায়। জীবনকে সফলতার মাপকাঠিতে বিচার করার অপূর্ব সুযোগ আসে। জীবন মহৎকর্মের ভেতর অতিবাহিত হয়ে থাকলে সার্থকতার শাখা-প্রশাখাগুলো খুঁজে বের করা সহজ হয় যা একজন যুবকের জন্য কিছুটা কঠিন। ঐ অর্থে যিনি যুবক তিনি জীবন ব্যবহার করার সুযোগ পেয়েছেন কম। হয়তো পাবেন। সুতরাং বয়েস বাড়া মানে জীবনের অলিতে গলিতে বিচরণের অভিজ্ঞতা অর্জন করা। জীবনের চড়াই-উৎড়াইকে পর্যবেক্ষণ করা, জীবনের সৌন্দর্যকে উপভোগ করা। বয়স বাড়া স্রষ্টার অমোঘ বিধান। আক্ষেপ করার কিছু নেই। বৃদ্ধও বেঁচে আছে, যুবকও বেঁচে আছে। এক্ষেত্রে সকলেই সমান। সুতরাং যেটুকু সময় বেঁচে আছি তার সদ্ব্যবহার করা জরুরি।

বয়স বাড়াকে আমরা তিন ঘণ্টার পরীক্ষা মনে করতে পারি। সময় গড়াবে, দায়িত্ব বাড়বে। শেষ সময়ে এসে একশো নম্বরের উত্তর করার অদম্য তাগাদা। সময়ের গুরুত্ব সকলের জন্য সমান। সময় বয়সের ভারে ক্লান্ত নয়। বরং যারা মনে করছে, তাদের সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে তাদের জন্য সময় অধিক গুরুত্বপূর্ণ। মহাকালের চিরন্তন রীতি অনুযায়ী জীবন অনেক ছোট। মানুষ মাত্রই একই রকম অনুভূতি। পৃথিবীর শুরু থেকে আজ অব্দি যতো মানুষ জন্মেছে, জন্মাচ্ছে, জন্মাবে। সকল মানুষের সাথে আমার জীবন তুলনীয় এবং সম্মিলিত জীবন, এটা সত্যি। কিন্তু পৃথিবীর বয়সের সাথে আমার জীবন তুলনা করলে তা বিন্দু কণা অণুর চেয়েও অনেক ছোট। এই ছোট্ট জীবনটিকে গোটা মানবজাতির সাথে একাত্ম করতে হলে চাই স্মরণীয় কাজ, মহৎকাজ।

বয়সের যেকোনো পর্যায়ের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানোর অন্য নাম সফলতা। চোখের সামনে কাজটি অপূর্ণ ইচ্ছে করলে আমি কাজটি সম্পন্ন করতে পারি কিন্তু করি নাই। আমার অভিজ্ঞতা হয়েছে বটে এর মূল্য নেই। উদাহরণ দিয়ে বলি- আমি হাঁটতে গিয়ে একটি গর্তে পড়ে গেছি কিন্তু গর্তটি ভরাট করার উদ্যোগ নেইনি। এই অভিজ্ঞতার মূল্য নেই। অভিজ্ঞতার নির্যাসে ভালো-মন্দ উভয় দিক রয়েছে। অনেক সময় অভিজ্ঞতা দুঃখ-কষ্টের গল্প শোনায়। আবার বয়েসী মানুষের অভিজ্ঞতা সুন্দর আগামীর সন্ধান দিতে পারে। বয়েসী মানুষের সংকল্প পাকাপোক্ত হয়। জীবনে সংকল্প একটা বড় বিষয়। যদিও এটা বয়সের বিষয় নয়। বরং যুবকের সংকল্প পৃথিবীকে আরো বেশি টেকসই সমৃদ্ধ করতে পারে। সুতরাং বেঁচে থাকার যেকোনো পর্যায়ে সংকল্প করা যেতে পারে। ব্যর্থতার মুখোমুখি না হবার পূর্বশর্ত সংকল্প। মানুষ ইচ্ছে করলেই অনায়াসে ব্যর্থতার দায় এড়াতে পারে যদি সংকল্প হয় বস্তুনিষ্ঠ।

সকলেই জানি, চলে যেতে হবে একদিন মরতে হবে। এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে হবে। কিন্তু সকলেই তা মানে না। যারা মানে তারা সফল মানুষ। তারা শ্রেয়বোধের চূড়ায় অবস্থান করে, মরেও অমর হয়। তারা কাজের ভেতর অমরত্ব আস্বাদন করে। কেউ মৃত্যুর দিকে আগায়, কেউ অমরত্বের দিকে। মনে করি, মৃত্যুকে জয় করার অন্যতম উপায় কাজ। জীবনের অপরিহার্য সত্য হলো মৃত্যু। মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। সেই মৃত্যুর মধ্যে জীবনের শেষ দেখার মানে ভীরুতা, কাপুরুষতা। মানুষের মৃত্যু পৃথিবীকে ভারসাম্যপূর্ণ করেছে। মৃত্যু কারো কাম্য না হলেও তা অবশ্যই বরণ করতে হবে। সুতরাং অবিরাম কল্যাণকর কর্ম সাধনের মধ্য দিয়ে মৃত্যুর পরও পৃথিবীতে অমরত্বের স্থায়ী আসন লাভ করা যেতে পারে। যদি ভাবি এই জীবন আমার, যার ভেতর আমি আছি অথচ আমি আমার শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। আমার হাত ভেঙ্গে যায়, দাঁত পড়ে যায়, আমি রক্ষা করতে পারি না। শরীরে নানারকম সমস্যা, আমি শরীরের কাছে অসহায়। সেই বিবেচনায় আমার এই জীবনটি, এই শরীরটি নিজের মনে না করে অন্যের প্রয়োজনে উৎসর্গ করাই শ্রেয়। তাতেই অনাবিল সুখ, অমরত্ব। তাতে করে প্রতিটি মানুষের মেধা, প্রজ্ঞা, ধীশক্তি, সৃজনশীলতা উত্তরাধিকারের জন্য উপহার হয়ে যেতে পারে।

মানুষের মধ্যে শিশুরা পৃথিবীর কোনো অনিষ্ট সাধন করতে পারে না, পশুপাখিও পারে না। পৃথিবীর সমস্ত অসুন্দর ও অনাচারের মূলে যেকোনো বয়সের পরিণত মানুষ। তাই একটাই পৃথিবীকে সুন্দর, আকর্ষণীয় এবং নান্দনিক করা মানুষের একমাত্র কাজ। সুতরাং ভালো কাজ মানেই সুন্দর পৃথিবী। প্রত্যাশা; বহুমুখিতায়, স্বপ্নচারিতায় মানুষ আজন্ম ভালো কাজে ডুবে থাকবে। সুন্দর পৃথিবী সেই মানুষকে অবশ্যই মনে রাখবে।

 

একটি নির্মল অঙ্গীকারের দৃঢ়তায় কবিগুরুর কয়েকটি পংক্তি উচ্চারণ করে লেখাটি শেষ করতে চাই-
যদি দুঃখ দহিতে হয়
তবু মিথ্যা চিন্তা নয়
যদি দৈন্য বহিতে হয়
তবু মিথ্যা কর্ম নয়
যদি দ- সহিতে হয়
তবু মিথ্যা বাক্য নয়
জয় জয় সত্যের জয়।

লেখক: অধ্যক্ষ, আবদুল কাদির মোল্লা সিটি কলেজ ও
সভাপতি, নরসিংদী জেলা স্কুল এন্ড কলেজ শিক্ষক সমিতি (নকশিস)।

 

 

 


বিভাগ : মতামত


এই বিভাগের আরও