জাতীয় সংসদ: একটি পর্যালোচনা- ড. মুহাম্মদ সোহরাওয়ার্দী

১৬ জানুয়ারি ২০১৯, ০১:৫০ পিএম | আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:৪৬ এএম


জাতীয় সংসদ: একটি পর্যালোচনা- ড. মুহাম্মদ সোহরাওয়ার্দী

আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকারকে শাসন বিভাগীয় কাজ, আইন বিভাগীয় কাজ ও বিচার বিভাগীয় কাজ সম্পাদন করতে হয়। আর এ তিন ধরনের কাজ সম্পাদনের জন্য রয়েছে সরকারের তিনটি বিভাগ। আইন বিভাগীয় কাজ সম্পাদন করে আইন বিভাগ। বাংলাদেশের আইন বিভাগের নাম জাতীয় সংসদ। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে ঔপনিবেশিক আমল ও পাকিস্তান আমলে প্রতিষ্ঠিত প্রাদেশিক আইনসভা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হলো:
ঔপনিবেশিক আমলে বাংলায় আইন সভা: ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নি¤œকক্ষ কমন্সসভার আদলে গঠিত হলেও বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ এককক্ষ বিশিষ্ট। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৬১ সালের কাউন্সিল আইনে সর্ব প্রথম ভারতে প্রতিনিধিত্বশীল ব্যবস্থার জন্ম হয়। এ আইনে মাদ্রাজ ও বোম্বাই সরকারকে আইন প্রণয়ন ক্ষমতা প্রদান করে ও অন্যান্য প্রদেশে অনুরূপ আইন পরিষদ গড়ে তোলার ভিত্তি রচনা করে। এ আইনের অধীনে ১৮৬২ সালের ১৮ জানুয়ারি বাংলায় সর্বপ্রথম ব্যবস্থাপক সভা প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে ১৮৯২ সালের ভারতীয় কাউন্সিল আইনের দ্বারা তা ব্যবস্থাপক সভার সদস্য সংখ্যা ১২ হতে বৃদ্ধি করে (২০)বিশে উন্নীত করা করা হয় এবং কিছু সংখ্যক বেসরকারি সদস্য পরোক্ষভাবে নির্বাচনের ব্যবস্থা রাখা হয়। ১৯০৯ সালের মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইনে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করে ৫০ এ উন্নীত করা হয়। পরবর্তীতে ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন উপমহাদেশের সাংবিধানিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধন করে। এ আইনের অধীনে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য সংখ্যা ১৪০-এ উন্নীত করা হয়। এ আইনের অধীনে ১৯২০-১৯৩০ সময় পর্যন্ত চারটি বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এসব নির্বাচনে ধীরে ধীরে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে স্বরাজপন্থীরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভায় সংসদীয় কার্যকমের মধ্যে প্রশ্ন উত্থাপন, মুলতরি প্রস্তাব, প্রস্তাবনা, বাজেট, প্রিভিলেজ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন চালুর সিদ্ধান্ত হওয়ায় ভারতীয় জনগণ তথা রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার সঞ্চার হয়। যদিও কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয় রাজনৈতিক দল ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন বিরোধী হলেও ১৯৩৭ সালে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রদেশিক আইন সভার নির্বাচনে মুসলমানদের জন্য নির্ধারিত ১১৭টি আসনের মধ্যে এ.কে ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন কৃষক-প্রজা পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে মুসলিমলীগের সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠন করেন। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের প্রভাবে এবং ১৯৪৫ সালে বাংলায় গভর্নরের শাসন জারি করায় বঙ্গীয় আইনসভা বাতিল করা হয়। ১৯৪৬ সালে বঙ্গীয় আইনসভার নির্বাচনে মুসলিমলীগ ১১৪ আসনে জয়লাভ করে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা গঠন করে। ব্রিটিশ ভারতের শাসনতান্ত্রিক পদক্ষেপগুলো এ অঞ্চলে ক্রমান্বয়ে সংসদীয় কাঠামো প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। এ সময়ে কেন্দ্র ও প্রাদেশিক আইনসভায় জনগণের প্রতিনিধিত্বের হার বৃদ্ধির পাশাপাশি সংসদীয় সরকার কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয়।
পাকিস্তান আমলে বাংলায় আইন সভা: ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন ও ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইনের আলোকে নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের আইনসভা গঠিত হয়। ১৯৪৬ সালে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় আইনসভার নির্বাচনে পূর্ববঙ্গ থেকে এবং আসাম লেজেসলেটিভ এ্যাসেম্বলীর সিলেট জেলা থেকে নির্বাচিত মোট ১৭১ জন সদস্যের সমন্বয়ে ইস্ট বেঙ্গল লেজেসলেটিভ এ্যাসেম্বলী গঠিত হয় যা ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত কার্যকর ছিল। ইস্ট বেঙ্গল লেজেসলেটিভ এ্যাসেম্বলীর প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৮ সালের ২৯ মার্চ ঢাকার জগন্নাথ হলে।
১৯৫৪ সালের পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন প্রাপ্তবয়স্কদের সার্বজনীন ভোটাধিকার এবং পৃথক নির্বাচনের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হয়। তাছাড়া ১৯৫৩ সালে ভারত শাসন আইনের (১৯৩৫) পঞ্চম ও ষষ্ঠ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে প্রাদেশিক পরিষদের মোট সদস্য সংখ্যা ৩০৯ স্থির করা হয়। এর মধ্যে ২৩৭টি আসন মুসলমানদের জন্য, ৩১টি সাধারণ আসন সাধারণ হিন্দুদের জন্য, ২৬টি আসন তফসিলী হিন্দুদের জন্য, ১টি আসন পাকিস্তানি খ্রিস্টানদের জন্য এবং ২টি আসন বৌদ্ধদের জন্য সংরক্ষিত করা হয়। মুসলমান, সাধারণ হিন্দু এবং তফসিলী হিন্দু এ তিন সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষিত আসন থেকে স্ব-স্ব সম্প্রদায়ের মহিলাদের জন্য যথাক্রমে ৯টি, ১টি এবং ২টি আসন সংরক্ষণ করা হয়। ১৯৫৪ সালের পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে মোট ১৬টি রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে। মুসলমানদের জন্য নির্ধারিত আসন প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী দলগুলো হলো: মুসলিম লীগ, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ, কৃষক-শ্রমিক পার্টি, নেজাম-এ ইসলাম, খেলাফতে রব্বানী পার্টি, গণতন্ত্রী দল, যুবলীগ, কমিউনিস্ট পার্টি উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া অমুসলিমদের আসনগুলোতে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী দলগুলো হলো: পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস, তফসিলী জাতি ফেডারেশন, পূর্ব পাকিস্তান সমাজতন্ত্রী দল, গণ সমিতি, কুমিল্লার অভয় আশ্রম এবং সংখ্যালঘু যুক্তরাষ্ট্র। যদিও ১৬টি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও এ নির্বাচন মূলত মুসলিম লীগ ও মুসলিম লীগ বিরোধী নির্বাচনে পরিণত হয়।
১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে মুসলমানদের জন্য নির্ধারিত ২৩৭টি আসনের মধ্যে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট ২২৮টি আসন লাভ করে, মুসলিম লীগ ৯টি আসনে জয়ী হয়। তাছাড়া অমুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত ৭২টি আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ১৩টি আসন, তফসিলী ফেডারেশন ২৭টি, কংগ্রেস ২৫টি আসনে জয় লাভ করে। এ নির্বাচনে মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয় ঘটে এবং যুক্তফ্রন্ট বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠে জয়লাভ করে। ঢাকার রমনাস্থ অ্যাসেম্বলী হাউজে (জগন্নাথ হল) ১৯৫৫ সালের ৫ আগস্ট পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এ পরিষদের স্থায়িত্ব ছিল ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত। ১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ গঠিত হয়। ১৫৫ আসনবিশিষ্ট এ পরিষদ আইয়ুব খানের ‘মৌলিক গণতন্ত্রী’দের মাধ্যমে গঠিত যা মেয়াদ ছিল ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত। ১৯৬৫ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ পূনরায় গঠিত হলেরও এর কার্যকাল সম্পর্কে জানা যায় নি।
পাকিস্তান আমলে গঠিত পূর্ব বঙ্গ প্রাদেশিক আইনসভা বিভিন্ন সময় গঠিত হলেও কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণমূলক নীতি এবং সামরিক শাসক আইয়ুব খানের শাসন ও শোষণের ফলে এ প্রতিষ্ঠানগুলো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে।
বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ: মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১র ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর এবং ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ১৬৯ জন সদস্য এবং পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের ৩০০ জন সদস্য অর্থাৎ সর্বমোট ৪৬৯ জন সদস্যের মধ্য হতে নানা অভিযোগে অভিযুক্ত ও সরকারি কর্মে নিযুক্ত হবার কারণে ৬৬ জন সদস্য বাদে ৪০৩ জন সদস্যের সমন্বয়ে ‘প্রভিশনাল কন্সটিটিউশন অব বাংলাদেশ অর্ডার ১৯৭২’ এর অধীন বাংলাদেশ গণপরিষদ গঠিত হয়। ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এ গণপরিষদে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদে জাতীয় সংসদ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে।
জাতীয় সংসদের গঠন: গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চম ভাগের প্রথম পরিচ্ছেদে আইনসভা/সংসদ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বাংলাদেশের জন্য একটি এককক্ষ বিশিষ্ট আইন সভা তথা জাতীয় সংসদ গঠনের কথা বলা হয়েছে। সংবিধানের ৬৫ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “জাতীয় সংসদ” নামে বাংলাদেশের একটি সংসদ থাকিবে...।” জাতীয় সংসদের আসন সংখ্যা ৩৫০টি। একক নির্বাচনী এলাকা হতে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে ৩০০ জন নির্বাচিত এবং ৫০টি আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত। তবে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসন থাকা সত্ত্বেও তাঁদের প্রত্যক্ষ ভোটে কোন আসনে কোন মহিলার নির্বাচিত হতে বাধা নেই।
সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবার যোগ্যতা ও অযোগ্যতা: বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৬ (১) অনুচ্ছেদে কোন ব্যক্তিকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হতে হলে নি¤েœাক্ত দুটি যোগ্যতা থাকতে হবে:
১. তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে;
২. তাঁকে অন্যূন ২৫ বছর বয়স্ক হতে হবে।
তাছাড়া সংবিধানের ৬৬ (২) অনুচ্ছেদ অনুসারে কোন ব্যক্তি জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হবার এবং সংসদ সদস্য থাকার যোগ্য হবেন না যদি :
(ক) কোন উপযুক্ত আদালত কর্তৃক অপ্রকৃতিস্থ ঘোষিত হন;
(খ) তিনি দেওলিয়া ঘোষিত হবার পর দায় হতে অব্যাহতি লাভ না করে থাকেন;
(গ) তিনি কোন বিদেশী রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব আর্জন করেন বা কোন বিদেশী রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা বা স্বীকার করেন;
(ঘ) তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোন ফৌজদারী অপরাধে দোষী সাবস্থ হয়ে অন্যূন দুই বৎসরের কারাদ-ে দ-িত হন এবং তাঁর মুক্তিলাভের পর পাঁচ বৎসরকাল অতিবাহিত না হয়ে থাকে’
(ঙ) তিনি ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ যোগসাজশকারী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশের অধীন কোন অপরাধের জন্য দ-িত হয়ে থাকেন;
(চ) তিনি প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকেন;
(ছ) অন্য কোন আইন দ্বারা বা অধীন অনুরূপ নির্বাচনের জন্য অযোগ্য হন।
জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার উল্লিখিত অযোগ্যতার পাশাপাশি সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ এর ১২(১) এর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচনে অযোগ্য হবেন-যদি বাংলাদেশের কোন সংসদীয় এলাকার ভোটার তালিকায় তাঁর নাম অর্ন্তভুক্ত না হয়ে থাকে, তিনি কোন রাজনৈতিক দলের মনোনাীত না হন বা স্বতন্ত্র প্রার্থী না হন, প্রজাতন্ত্রের লাভজনক কোন পদে অধিষ্ঠিত থাকেন, প্রজাতন্ত্রের কর্ম হতে অবসরগ্রহণ, পদত্যাগের পর ৩ বছর অতবাহিত না হয়, প্রজাতন্ত্রে কর্ম হতে অপসারণ বা বরখাস্ত করা হয়েছে বা বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান করা হয়েছে বা একক বা সংঘবদ্ধভাবে দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে সাজাভোগের পরবর্তী নির্ধারিত সময় অতিবাহিত না হলে, রাষ্ট্র বা সরকারের সাথে চুক্তিবদ্ধ নিয়োগ লাভ করেছেন এমন ব্যক্তি চুক্তির মেয়াদ শেষ না হলে নির্বাচনে অংশগ্রহণে অযোগ্য বিবেচিত হবেন। তাছাড়া ব্যক্তিগতভাবে যিনি টেলিফোন, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানিসহ অন্যান্য বিলখেলাপী, ব্যাংক বা অন্যকোন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঋণখেলাপী এমন ব্যক্তি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।
সদস্য আসন শূন্য হওয়ার কারণ: জাতীয় সংসদ সদস্যদের আসন শূন্য হওয়া সম্পর্কে সংবিধানের ৬৭ অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে। সংবিধানের ৬৭ (১) এ বলা হয়েছে (ক) কোন সংসদ সদস্যের পদ শূন্য হবে যদি নির্বাচিত হবারপর সংসদের প্রথম বৈঠকের তারিখ হতে নব্বই দিনের মধ্যে তিনি শপথ গ্রহণ না করেন; (খ) কোন জাতীয় সংসদ সদস্য যদি সংসদের অনুমতি না নিয়ে একাদিক্রম নব্বই বৈঠক দিবস অনুপস্থিত থাকেন; (গ) জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে গেলেও সংসদ সদস্যের আসন শূন্য হবে। তাছাড়া সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুসারে যদি কোন সংসদ সদস্য কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে নির্বাচিত হয়ে পরবর্তী সময়ে উক্ত দল থেকে পদত্যাগ করেন বা সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোট দান করেন, তা হলে তাঁর আসন শূন্য হবে। সংবিধানের ৬৭ (২) অনুচ্ছেদ অনুসারে, কোন সংসদ সদস্য যদি স্পীকারের নিকট স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে স্বীয় পদ ত্যাগ করেন তবে স্পীকার যখন উক্ত পত্র প্রাপ্ত হন তখন তাঁর সংসদ সদস্য পদ শূন্য হবে।
সংবিধানের ৭২অনুচ্ছেদ অনুসারে, রাষ্ট্রপতি সরকারি বিজ্ঞপ্তি দ্বারা সংসদ অধিবেশন আহবান, স্থগিত ও ভঙ্গ করতে পারবেন। রাষ্ট্রপতি পূর্বে ভেঙ্গে না দিলে প্রথম বৈঠকের তারিখ হতে সংসদের মেয়াদ হবে পাঁচ বছর। সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হবার ৩০ দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতি সংসদের অধিবেশন আহবান করবেন।
জাতীয় সংসদের ক্ষমতা ও কার্যাবলি: বাংলাদেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার বিদ্যমান থাকায় জাতীয় সংসদই সার্বভৌম আইন প্রণয়নকারী সংস্থা। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান ও জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালী-বিধি অনুযায়ী সংসদ পরিচালিত হয়। জাতীয় সংসদ বাংলাদেশের জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী সর্বোচ্চ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। নি¤েœ জাতীয় সংসদের ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলোচনা করা হল :
১. আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত ক্ষমতা ও কার্যাবলি: সংবিধানের নির্দেশনা অনুসারে বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করার ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ন্যস্ত। সংসদের প্রথম ও প্রধঅন কাজ হলো আইন প্রণয়ন করা। সংবিধানের ৬৫ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সংবিধানের বিধানাবলী-সাপেক্ষে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা সংসদের উপর ন্যস্ত হবে। আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সংবিধানের ২৬, ৮০, ৮২, ৮৯, ৯৩ অনুচ্ছেদ বিশেষভাবে বিবেচনা করে থাকে। আইন প্রণয়ন ছাড়াও জাতীয় সংসদ সংবিধান ও কার্যপ্রণালী-বিধি অনুযায়ী আইন সংশোধন, পরিবর্তন এমনকি আইন বাতিল করতে পারে।
২. সরকার গঠন: সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় সরকার গঠনে আইন সভার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশের মূল সংবিধানে এবং দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৯১ সালে দেশে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা পূনঃপ্রবর্তনের ফলে সরকার গঠনে সংসদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সাধারণ নির্বাচনের পর নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দলের নেতা/নেত্রীকে রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৫৬(৩) অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী যেরূপ নির্ধারণ করেন সেরূপ অন্যান্য মন্ত্রীদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। তবে মন্ত্রীদের নয়-দশমাংশ সংসদ সদস্যদের মধ্য হতে নিযুক্ত হন। সংসদীয় বা মন্ত্রী পরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থায় দেশ শাসনের ক্ষমতা মন্ত্রীপরিষদের হাতে ন্যস্ত থাকলেও সরকার গঠনে সংসদের ভূমিকাই প্রধান।
৩. শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ: সংবিধান অনুযায়ী জাতীয় সংসদ শাসন বিভাগ বা মন্ত্রিসভাকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে সংবিধানের ৫৫ (৩) অনুচ্ছেদ অনুসারে মন্ত্রিসভা যৌথভাবে তাঁদের কাজের জন্য সংসদের নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য। ব্রিটেনের কমন্সসভার ন্যায় জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মন্ত্রীদেরকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা, নিন্দামূলক প্রস্তাব, বাজেট আলোচনা-সমালোচনা, মুলতবি প্রস্তাব’ দৃষ্টি আকর্ষণী প্রস্তাব উত্থাপন করে জাতীয় সংসদ মন্ত্রিসভাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সংসদের অনাস্থায় মন্ত্রিপরিষদ অপসারিত হয়।
৪. নির্বাচনমূলক কার্যবলি: সংবিধানের ৪৮ (১) অনুচ্ছেদ অনুসারে জাতীয় সংসদ সদস্যদের ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন। তাছাড়া সংবিধানের ৭৪ (১) অনুচ্ছেদ অনুসারে সংসদ স্পীকার এবং ডেপুটি স্পীকারকে নির্বাচন করে থাকেন। বিভিন্ন কমিটি নির্বাচন করার ক্ষমতার পাশাপাশি তাদেরকে অপসারণ করা ক্ষমতারও সংসদের হাতে ন্যস্ত। মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ৫০টি আসনে মহিলা সদস্যগণ নির্বাচিত সদস্যদের দ্বারা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির ভিত্তিতে একক হস্তান্তরযোগ্য ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হন।
৫. অর্থ সংক্রান্ত ক্ষমতা ও কার্যাবলি: সংসদের গুরুত্বপূর্ণ অর্থবিষয়ক ক্ষমতা রয়েছে। সংবিধানের ৮৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সংসদের অনুমোদন ব্যতীত জনগণের উপর কোন কর আরোপ বা সংগ্রহ করা যায় না। তাছাড়া সংবিধানের ৮৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে সংসদ আইনবলে সরকারি অর্থ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সংবিধানের ৮৭ অনুচ্ছেদ অনুসারে, সরকারের বার্ষিক অনুমিত আয়-ব্যয় সংবলিত একটি বিবৃতি অর্থাৎ ‘বাজেট’ সংসদে প্রতি বছর উত্থাপন করা হয়।
৬. সংবিধান-সংশোধন: বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধন করার ক্ষমতা একচ্ছত্রভাবে জাতীয় সংসদের হাতেই ন্যস্ত। সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সংসদ মোট সদস্যগণের দুই-তৃতীয়াশং সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সংবিধানের কোন বিধান সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন বা রহিতকর করতে পারে।
৭.অধ্যাদেশ সংক্রান্ত ক্ষমতা : সংবিধানের ৯৩ অনুচ্ছেদ অনুসারে সংসদ ভেঙ্গে গেলে বা সংসদ অধিবেশ না থাকলে রাষ্ট্রপতি যে সকল অধ্যাদেশ জারি করেন সেগুলো সংসদের প্রথম অধিবেশনে বা সংসদের পরবর্তী অধিবেশনে উপস্থাপন করতে হবে। সংসদে এ সকল অধ্যাদেশ অনুমোদিত হলে তা আইনে পরিণত হবে এবং অনুমোদিত না হলে এ সকল অধ্যাদেশের র্কাকারিতা লোপ পাবে।
৮. জরুরি অবস্থা ঘোষণা সংক্রান্ত ক্ষমতা: বাংলাদেশ সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনীবলে রাষ্ট্রপতিকে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার ক্ষমতা দেওয়া হয়। সংবিধানের ১৪১ক অনুচ্ছেদ অনুসারে যুদ্ধ বা বহিরাক্রমণ বা অভ্যন্তরীণ গোলযোগের দ্বারা বাংলাদেশে বা এ যে কোন অংশের নিরাপত্তা বা অর্থনৈতিক জীবন বিপদের সম্মুখীন হলে রাষ্ট্রপতি জরুরী অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন। তবে রাষ্ট্রপতির জরুরী ঘোষণা সংক্রান্ত আদেশ সংসদে ১২০ দিনের মধ্যে বা সংসদ ভেঙ্গে গেলে তা পুনর্গঠিত হবার পর সংসদের প্রথম অধিবেশনের ৩০ দিন অতিবাহিত হবার পূর্বে ঘোষণাটি সংসদ কর্তৃক গৃহীত না হলে উক্ত সময়ের অবসানে তা অকার্যকার হয়ে পড়বে।
৯. বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতা: জাতীয় সংসদ বিচার বিভাগীয় ক্ষমতা ভোগ ও কার্যাদি সম্পন্ন করে। সুপ্রীম কোর্টের বিচারক অপসাণের ক্ষেত্রে জাতীয় সংসদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সংবিধানের ৫২ অনুচ্ছেদ অনুসারে সংবিধান লংঘন, গুরুতর অপরাধ বা অসাদচরণের জন্য কিংবা দৈহিক ও মানসিক অক্ষমতার জন্য সংসদ রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে সংসদে প্রস্তাব আনয়ন করতে পারে। সংবিধানের ৫৩ অনুচ্ছে অনুসারে সংসদের মোট সদস্যের দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থনে প্রস্তাব গৃহীত হলে রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসনের মাধ্যমে সংসদ অপসারিত করতে পারে।
১০. চাকরি-সংক্রান্ত ক্ষমতা ও কার্যাবলি: সংবিধানের ১৩৩-১৩৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে, সংসদ আইনবলে প্রজাতন্ত্রের কর্মে বা চাকরিতে কর্মচারিগণের নিয়োগ ও কর্মের শর্তাবলি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। সংসদের আইনের দ্বারা প্রজাতন্ত্রের কর্মবিভাগ ও সার্ভিসসমূহ সৃষ্টি ও পূনর্গঠন করা যাবে।
১১. সামাজিকীকরণ: সংসদ রাজনৈতিক সামাজিকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সংসদে অনুষ্ঠিত আলোচনায় সংসদ সদস্যগণ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও উপাত্ত প্রদান করেন। সংষদ সদস্যগণ সংসদীয় কর্মকা-ে অংশগ্রহণ করে গণতন্ত্রের চর্চা, মূল্যবোধ, জবাবদিহিতা, সমালোচনা, বৈধতা ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা লাভ করেন যা তাঁদেরকে রাজনৈতিক সামাজিকীকরণে ইতিবাচক ভূমিকা পালনে সচেষ্ট করে।
১২. শিক্ষামূলক কাজ: সংসদে অনুষ্ঠিত আলোচনা ও বির্তকে সংসদ সদস্যগণ অংশ নিয়ে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত তুলে ধরেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংসদের অধিবেশন সরাসরি প্রচার করা হয় যা নাগরিকদের রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টিতে ইতিবাচক প্রভাব রাখে। তাছাড়া সংসদে বির্তক, প্রশ্ন জিজ্ঞাসা ও বিভিন্ন কমিটিতে নবীন সদস্যগণ অংশগ্রহণের মাধ্যমে রাজনৈতিক জ্ঞান লাভ করেন যা ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরিতে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে থাকে।
উল্লিখিত আলোচনার প্রেক্ষাপটে বলা যায় একটি দেশের আইন প্রণয়ন, আইন সংশোধন কিংবা বাজেট প্রণয়ন সহ সার্বিক কর্মকা-ই আইন সভা কর্তৃক অনুমোদিত হতে হবে। কেননা জাতীয় সংসদকে ঐড়ঁংব ড়ভ ঃযব ঘধঃরড়হ বলা হয়। লাখো শহীদের রক্তে লেখা বাংলাদেশের সংবিধানের একটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি হলো গণতন্ত্র। সংসদীয় পদ্ধতির সরকার দীর্ঘদিনের আকাঙ্খা হলেও লাগাতার সংসদ বর্জন, কোরাম সংকট, দলীয় রাজনীতির আনুগত্য, সংসদীয় রাজনীতির চর্চার অভাব জাতীয় সংসদকে নানভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। একটি উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ স্থান করে নিতে হলে সংসদকে সকল আলোচনার বা সরকারের সকল কাজের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে হবে।

লেখক পরিচিতি: সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, নরসিংদী সরকারি মহিলা কলেজ।

 


বিভাগ : মতামত


এই বিভাগের আরও