নরসিংদীর বিখ্যাত অমৃতসাগর কলা আজ বিলুপ্তির পথে

১২ মার্চ ২০১৮, ০২:২৬ এএম | আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:২৫ পিএম


নরসিংদীর বিখ্যাত অমৃতসাগর কলা আজ বিলুপ্তির পথে
অনলাইন ডেস্ক [caption id="attachment_1932" align="alignnone" width="732"] ছবিঃ সংগৃহীত[/caption] নরসিংদীর সাগরকলার সুখ্যাতি রয়েছে পাক-ভারত, উপ-মহাদেশসহ ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত। বিশেষ করে নরসিংদীর অমৃত সাগর কলার নাম শুনেনি এমন লোকের সংখ্যা খুবই কম। সপ্তম ও অস্টম শ্রেণীর ভূগোল বইয়ে নরসিংদীর সাগর কলার সুখ্যাতির কথা উল্লেখিত রয়েছে। পাহাড়ী উচ্চ ভূমি, পাহাড়ী সমতল, সমতল ও নিম্ন ভূমি নিয়ে গঠিত নরসিংদী জেলার ভূ-প্রকৃতিতে উৎপাদিত অমৃত সাগর কলা রাজধানী ঢাকা ও ভারতীয় উপমহাদেশ ছাপিয়ে ইউরোপের বাজার পর্যন্ত ছুঁয়েছিল। স্বাদে, গন্ধে ভরপূর নরসিংদীর অমৃত সাগর কলার সাথে উপমহাদেশ তথা পৃথিবীর কোন দেশের কলার তুলনা মিলেনি। নরসিংদী জেলার পলাশ, শিবপুর, মনোহরদী, বেলাব, রায়পুরা ও নরসিংদী সদর উপজেলার সকল এলাকায়ই অমৃত সাগরের চাষাবাদ হতো। প্রাপ্ত তথ্য মতে নরসিংদী জেলার ৬টি উপজেলার ১৭ হাজার একর জমিতে অমৃত সাগর কলা চাষাবাদ হতো। জেলায় অমৃত সাগর কলা এত বেশী উৎপাদিত হতো যে, এই কলা নরসিংদী থেকে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে রফতানীর জন্য কলার গাড়ী নামে একটি ট্রেন পর্যন্ত চালু হয়েছিল। নরসিংদী জেলা শহরের রেলস্টেশনসহ ১০টি রেলস্টেশনের প্লাটফরমগুলোতে দুপুর থেকে জমা হতে থাকতো সাগর কলার টুকরি। ছোট বড় টুকরিতে সাজানো সাগর কলা স্টেশনে জমা হলে এক অপূর্ব দৃশ্যের অবতারনা ঘটতো। সন্ধ্যার পর কলার গাড়ী এলেই প্রতিটি স্টেশন থেকে এই টুকরিগুলো গাড়ীতে উঠানো হতো। জনশ্রæতি রয়েছে মনোহরদীর সাগরদী গ্রামে নামকরণ করা হয়েছে নরসিংদীর সাগরকলার নামে। শুধু তাই নয়, সাগরদী বাজারও সাগর কলার নামে নামকরণ করা হয়েছে। এছাড়াও নরসিংদীতেও সাগরদী নামে একটি গ্রামের নাম রয়েছে। এছাড়া সড়ক ও নৌ পথেও প্রচুর সংখ্যক কলা দেশের বিভিন্ন স্থানে রফতানী হতো। প্রবীন জনেরা জানিয়েছে ঢাকার নবাবরা নিজেরা অমৃত সাগর কলা খেতো, তাদের আদিম বাসভূমি কাশ্মীরে প্রেরণ করতো সাগর কলা। ব্রিটিশ শাসনামলে ইংরেজ ভাইসরয়রা এসব অমৃত সাগর কলা দিয়ে রাষ্ট্রীয় অতিথিদেরকে আপ্যায়িত করতো। সেই রেয়াজ এখনো চালু রয়েছে। এখনো বঙ্গভবন, গণভবনসহ সকল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন সমূহে নরসিংদীর অমৃত সাগর কলা দিয়ে অতিথিদেরকে আপ্যায়িত করা হয়ে থাকে। তবে নরসিংদীর সেই অমৃত সাগর কলা এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। মাটিতে জৈবসারের পরিমান কমে যাওয়া, অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহার, অপরিকলিপ্ত চাষাবাদ, সারের দাম বৃদ্ধি পাওয়া, রোগবালাই দমনে কীটনাশকের অভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, এক চেটিয়া কলাচাষের কারণে মাটির উর্বরা শক্তি হ্রাস, কলা প্রদান এলাকাগুলোতে বসতি স্থাপন, উৎপাদিত কলা সংরক্ষণে বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থার অভাব এবং অমৃত সাগর কলা চাষে প্রয়োজনীয় ঋণের অভাব ইত্যাদি কারণে অমৃত সাগর কলা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। [caption id="attachment_1933" align="alignnone" width="800"] ছবিঃ সংগৃহীত[/caption] বর্তমানে অমৃত সাগর কলা চাষাবাদ নেই বললেই চলে। বর্তমানে অমৃত সাগর কলার জায়গা দখল করেছে উচ্চ ফলনশীল জাতের কলা। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট আবিস্কৃত বারি-১ জাতের কলা এখন অমৃত সাগরের ক্ষেতগুলোতে চাষাবাদ হচ্ছে। তবে বারি-১ বা উচ্চ ফলনশীল জাতের কলা জনগনের কাছে ততটা গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। উচ্চ ফলনশীল জাতের কলায় অমৃত সাগরের সেই স্বাদ ও গন্ধ নেই। এসব কলার স্বাদ অনেকটাই কষ্টি ও পানসে মিষ্টি ধরনের। কোন কোন কলা টক মিষ্টি স্বাদেরও হয়ে থাকে। আবার কোন কোনটি অনেকটাই পানসে স্বাদের। কিন্তু এর ফলন মোটামুটি বেশ ভাল। নরসিংদী সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল হাই জানিয়েছেন, বারি-১ জাতের কলার একটি ছড়ায় সর্বোচ্চ ২২ কাঁদি পর্যন্ত কলা ফলে থাকে। কিন্তু এর স্বাদ কোন ক্রমেই অমৃত সাগরের সমকক্ষ নয়। প্রবীন কলা চাষীরা জানিয়েছে, অমৃত সাগর কলার সাথে দুধের রয়েছে এক অপূর্ব রাসায়নিক মিল। অমৃত সাগর কলা পাকলে ঘরের ভিতরই সু-গন্ধে ভরে যায়। বাগানের গাছে পাকলে সারা বাগান গন্ধে মোহিত হয়ে যায়। এর উপর দুধের সাথে মিশ্রন ঘটলে সারা ঘরে এর মৌ মৌ সু-গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। কৃষি বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, নরসিংদীর অমৃত সাগর কলার এই মিষ্টি গন্ধ ও মিষ্টি স্বাদ এর মাটির গুনেই হয়ে থাকে। নরসিংদীর এই কলা অন্য কোন জেলা বা এলাকায় রোপন করলে গাছ বড় হয়, কলাও ফলে। কিন্তু নরসিংদীতে উৎপাদিত অমৃত সাগর কলার মত স্বাদ ও গন্ধ হয় না। মাটির গুনগত বৈশিষ্টের কারণেই নরসিংদীর অমৃত সাগর দেশ তথা বিদেশে এতটা সমাদৃত হয়েছে। যারা একবার অমৃত সাগর কলা খেয়েছে তারা অন্য কোন কলা খেয়ে সেই স্বাদ পাচ্ছে না। বাইরে থেকে নরসিংদীতে মেহমান এলে প্রথমে যেটা দাবী করে সেটা হচ্ছে অমৃত সাগর কলা। মেজবানরা হন্যে হয়ে বাজারে বাজারে ঘুরে অমৃত সাগর সংগ্রহ করে মেহমানদেরকে আপ্যায়িত করে। বাজারগুলোতে খুব একটা অমৃত সাগর কলা পাওয়া যায় না। যা কিছু পাওয়া যায় তার দাম শুনলে চোখ কপালে উঠে যায়। কলার উৎপাদন কমে যাবার কারণেই এমনটা হয়েছে বলে জানিয়েছে কলা বিক্রেতারা। [caption id="attachment_1934" align="alignnone" width="665"] ছবিঃ সংগৃহীত[/caption] নরসিংদীর কৃষি স¤প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক লতাফত হোসেন জানিয়েছেন, অমৃত সগর কলা জাত সংরক্ষণে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বিদেশীরা নরসিংদীর অমৃত সাগর কলার প্রতি খুবই আকৃষ্ট হয়েছেন। তারা এই কলাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কৃষি স¤প্রসারণ বিভাগকে অনুরোধ জানিয়েছেন। কৃষি স¤প্রসারণ বিভাগ অমৃত সাগর কলাকে রক্ষা করার জন্য মনোহরদীতে ৩ বিঘা জমিতে প্রদর্শনী বাগান তৈরী করেছে। বর্তমানে বিভিন্ন কারণে নরসিংদীতে কলার চাষ কমে গেছে। নরসিংদী জেলায় বর্তমানে ২ হাজার ১৩৫ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের কলা চাষাবাদ হয়ে থাকে। এর মধ্যে বিদেশী নেপালী কলা, বারি ১ জাতের কলা চাষাবাদ হচ্ছে। তবে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন অচিরেই আবার অমৃত সাগরের চাষাবাদ ব্যাপক আকার ধারণ করবে।