মাধবদীতে লাগামহীন সুতার দামে সংকটে টেক্সটাইল শিল্প

১৫ অক্টোবর ২০২১, ০৯:১১ পিএম | আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১১:২৪ পিএম


মাধবদীতে লাগামহীন সুতার দামে সংকটে টেক্সটাইল শিল্প

নিজস্ব প্রতিবেদক:

নরসিংদীর মাধবদীতে অব্যাহতভাবে সুতার দাম বাড়ার কারণে সংকটে পড়েছেন টেক্সটাইল শিল্প মালিকরা। শুধু গ্রে কাপড় উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল সুতার দাম নয়, বৃদ্ধি পেয়েছে টেক্সটাইল মেশিনের যন্ত্রাংশ ও অন্যান্য আনুষাঙ্গিক জিনিসপত্রের দামও। এতে কাপড় উৎপাদনের খরচ বাড়লেও সে তুলনায় বাড়েনি কাপড়ের দাম। এছাড়া করোনার কারণে দেশের বাজারে কাপড়ের তেমন চাহিদা না থাকায় কারখানায় জমা হচ্ছে উৎপাদিত গ্রে কাপড়ের স্তুপ। অব্যাহত লোকসানে অনেকে টেক্সটাইল শিল্প বন্ধের কথা ভাবছেন। সেইসাথে বেকার হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন কয়েক হাজার শ্রমিক।

টেক্সটাইল শিল্প মালিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, শিল্পাঞ্চল মাধবদীতে রয়েছে ৬ হাজারেরও বেশি টেক্সটাইল শিল্প। নরসিংদী এবং পার্শ্ববর্তী নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে দেশের চাহিদার প্রায় ৯০ শতাংশ কাপড় উৎপাদন হয়। এরমধ্যে শুধু মাধবদীতেই উৎপাদিত হয় ৭৫ শতাংশ গ্রে কাপড়। এই অঞ্চলের টেক্সটাইলের চাহিদা অনুযায়ী সুতার বেচাকেনা হয় শিল্প শহর মাধবদীতে। দিনের পর দিন সুতার বাজার অস্থিতিশীল থাকলেও এসব নিয়ন্ত্রণের কোন কর্তৃপক্ষ নেই। গত ৬ থেকে ৭ মাসে অধিকাংশ সুতার মূল্য বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।

টেক্সটাইল শিল্প মালিকদের অভিযোগ, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে পাউন্ড প্রতি সুতার দাম বেড়েছে প্রায় ১৫ টাকা। একবস্তা সুতা কিনতে ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা বেশি গুণতে হচ্ছে । এতে গজ প্রতি কাপড়ের উৎপাদন খরচ প্রায় ৩ টাকা বেড়ে গেলেও বাজারে মিলছে না কাপড়ের কাঙ্খিত দাম। মাধবদীর সুতার বাজারের মূল্য নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই এখানকার কয়েকটি শীর্ষ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের হাতে নির্ভরশীল।  এগুলোর মধ্যে আনন্দ ইয়ার্ণ ট্রেডিং, মডার্ন ইয়ার্ণ ট্রেডিং, এনায়েত ট্রেডার্স, একতা ট্রেডার্স, হক ট্রেডার্স, সজিব ট্রেডার্স ও বনানী ট্রেডার্স অন্যতম।  

মাধবদী বাজার ঘুরে দেখা যায়, এসএন, হামজা, জাকিয়া, এসএ, এমএ এইচ, মুক্তা, সাবেদ আলী, কুমিল্লা, লিটল স্টার প্রভৃতি ব্র্যান্ডের সুতা রয়েছে। বৃহস্পতিবার  এসব ব্র্যান্ডের পাউন্ড প্রতি সুতার বর্তমান দাম ৬০ কাউন্ট ২১০ টাকা, ৪৫ কাউন্ট টিসি ৫৮ টাকা, ৫০ কাউন্ট (বাইনের সুতা) ৯৫ টাকা, ৫০ কাউন্ট (তানা সুতা) ১৮৮ টাকা,  ৪০ কাউন্ট (কটন সুতা) ১৭২ টাকা, ৩০ কাউন্ট ৭৫ টাকা, ২০ কাউন্ট ১৩০ টাকা। গত একমাস আগেও এগুলোর দাম পাউন্ড প্রতি প্রায় ৩৫ থেকে ৪৫ টাকা কম ছিলো ।

টেক্সটাইল মালিকরা সুতার লাগামহীন দাম বাড়ার জন্য সরকারের নজরদারীর অভাবকে অনেকাংশে দায়ী করেন। তারা জানান, দেশের শীর্ষভাগ কাপড়ের যোগানদাতা এই বস্ত্রশিল্পের কাঁচামালের বাজারে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কোন নজরদারী না থাকা এবং পণ্যের গায়ে নির্ধারিত মূল্য না থাকায় কতিপয় অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজারে সুতার কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলছে।

মাধবদীর মনোহরপুরের এএস টেক্সটাইল মিলের মালিক গাজী সফিকুল ইসলাম জানান, সুতার বাজারের অস্থিরতার কারণে অনেকেই শুধুমাত্র রাতের শিফট মিল চালাচ্ছেন। সুতার বাজার দরের এই অবস্থা চলতে থাকলে এটুকুও বন্ধ করে দিতে হবে। এতে বেকার হবেন অনেক শ্রমিক। এমতাবস্থায় টেক্সটাইল শিল্পকে বাঁচাতে প্রশাসন কর্তৃক বাজার মনিটরিংসহ সুতার প্যাকেটে মূল্য লেখার প্রচলন করার দাবি জানান তিনি।

দোলন সাহা নামে আরেক শিল্প মালিক জানান, দেশের তৈরি পোশাক শিল্প মালিকরা বিদেশ থেকে বন্ডের মাধ্যমে শুল্কমুক্ত সুবিধায় সুতা আনার সুযোগসহ নানারকম সুবিধা পাচ্ছেন। এসব পোশাক শিল্প মালিকদের অনেকেরই আবার স্পিনিং মিলও রয়েছে। নিজেরা শুল্কমুক্ত সুবিধা ভোগ করলেও টেক্সটাইল মালিকদের সুতা আমদানীতে সরকারী সুযোগ সুবিধা পেতে তারাই প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে টেক্সটাইল মালিকদের মালিকদের সুতা আমদানিতে সাড়ে ৩৭ শতাংশ শুল্ক গুণতে হয়। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই দেশ থেকে সুতা কিনতে হয়। আর এই সুযোগকেই কাজে লাগায় ওসব সুবিধাভোগী স্পিনিং মিল মালিকেরা।

তিনি আরো বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তুলার মূল্য কেজি প্রতি কখনো ২০ সেন্ট বাড়লে আমাদের দেশের স্পিনিং মিল মালিকরা বাড়িয়ে দিচ্ছেন পাউন্ড প্রতিই ২০ টাকা। এই অবস্থায় সরকারের শুল্কমুক্ত সুবিধায় টেক্সটাইল মালিকদের সুতা আমদানীর সুযোগ দেয়া উচিৎ।

সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সুতার দাম বাড়ানোর অভিযোগ অস্বীকার করেন সজীব ট্রেডার্সের মালিক উৎপল সাহা জানান, করোনার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে সুতার দাম প্রকৃত অর্থেই বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের বাজারে সুতার দাম বেড়েছে। প্রতিযোগিতার বাজারে প্রত্যেক ব্যবসায়ীই চান সর্বোচ্চ সুবিধা দিয়ে গ্রাহকদেরকে ধরে রাখতে, সেখানে সিন্ডিকেট করার প্রশ্নই আসে না।

মাধবদীতে সপ্তাহে প্রায় আড়াই হাজার টন সুতার চাহিদা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, দিনদিন চাহিদা  আরো বাড়ছে, কিন্তু সেই তুলনায় সুতার উৎপাদন নেই। তবে নভেম্বরের মাঝামাঝি দিকে বিদেশ থেকে আমদানীকৃত নতুন তুলা স্পিনিং মিলগুলোতে আসা শুরু করলে বাজার অনেকটাই স্থিতিশীলতায় চলে আসবে।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস এসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও নরসিংদী চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, দেশের বাজারে প্রচলিত সুতা তৈরির চেয়ে বিদেশে রপ্তানিমুখী সুতায় লাভ বেশি হওয়ায় স্পিনিং মিল মালিকরা দিনদিন রপ্তানিমুখী সুতা তৈরীর দিকেই বেশি ঝুঁকছেন। এতে দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে সুতার উৎপাদন না থাকায় সংকট বেড়ে চলেছে। পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের মধ্যেও কতিপয় বেশি পয়সাওয়ালাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত সুতা কিনে মজুদ করে রাখার প্রবণতার কারণেও বাজারে সংকট দেখা দিচ্ছে। তবে দ্রুত এই সংকট সমাধান হওয়া উচিত।