ভাষা আন্দোলন মূলত আমাদের অস্তিত্বের আন্দোলন

১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০২:৫১ পিএম | আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৩৫ এএম


ভাষা আন্দোলন মূলত আমাদের অস্তিত্বের আন্দোলন

 

                        --মহসিন খোন্দকার--
 
 
এই ভূ-খন্ডে আমরা কোনো অধিকার খুব সহজে পাইনি। অস্তিত্ব রক্ষার্থে ও অধিকার আদায়ে যুগ-যুগান্তরে বহু আন্দোলন,লড়াই-সংগ্রাম,বিপ্লব-বিদ্রোহ করেছি আমরা। এসবের মধ্যে নীল বিদ্রোহ,সিপাহী বিদ্রোহ, ফকির বিদ্রোহ,সন্যাস বিদ্রোহ,লবণ বিদ্রোহ, ফরায়েজি আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, তেভাগা আন্দোলন, টংক আন্দোলন, ইজারা বিরোধী আন্দোলন, জলমহাল আন্দোলন, ফকির বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, সত্যাগ্রহ, অসহযোগ আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন এ রকম বহু আন্দোলন,লড়াই-সংগ্রামে,বিদ্রোহে-বিপ্লবে শাণিত বাঙালি একটি গাঢ় গভীর চেতনা কেন্দ্রীক সাংস্কৃতিক আন্দোলনও করেছে যার নাম 'ভাষাআন্দোলন'।
 
ভাষাআন্দোলন প্রকৃত পক্ষে আমাদের চেতনা রক্ষার আন্দোলন। কোনো জাতির ভাষা কেড়ে নেওয়া মানে তাকে শুধু বোবা বানানোই নয়,জাতিটির অস্তিত্ব, সাহিত্য-সংস্কৃতি,কৃষ্টি-কালচার,আচার-অনুষ্ঠানকে সমূলে উৎপাটন করার নামান্তর। ভাষা শুধু ভাবেরই বাহননা,একটি জাতির অন্যতম পরিচয়ও বটে। আমরা কী,কেমন,কীভাবে,কী করি,কী বলি,কী করিনা সম্পূর্ণ জীবনাচার পরিস্ফুট হয় ভাষার মাধ্যমে।ভাষা হলো আমাদের হৃদয়ের শাব্দিক অলংকার,অন্তরের একান্ত অনুরণন।
 
পৃথিবীতে প্রায় সাত হাজারের বেশি ভাষা আছে। সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ভাষার নাম মান্দেরিয়ান, তারপর ইংলিশ,তারপর স্পেনিশ, রাশিয়ান, আরবি, বাংলা, পর্তুগিজ ও ফ্রেন্স। এসব তালিকার অনেক পেছনে উর্দুর অবস্হান।পৃথিবীতে বাংলাভাষা এবং ভাষাআন্দোলন নিয়ে শুধু মাত্র আমরাই গর্ব করতে পারি। কারণ ভাষার জন্যে প্রাণ শুধু বাঙালিরাই দিয়েছে। পৃথিবীতে আর কোনো জাতির এই গর্ব নেই।আর পৃথিবীতে সাতহাজার বা তার বেশি ভাষা থাকলেও নিজ ভাষায় সাহিত্য চর্চা করে সাহিত্যের সর্বোচ্চ পুরস্কার খেতাব নোবেল পাওয়া খুবই সম্মানজনক। যা বাংলা ভাষার প্রধান কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পেয়েছিলেন ১৯১৩ সালে। যা আমাদের বাংলাভাষাকে পৃথিবীর বুকে স্হায়ী আসন করে দিয়েছিল, অতি উজ্জ্বল করেছিল আমাদের অহংকারের চূড়াকে। আর জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে নিজ ভাষা বাংলায় বক্তব্য দিয়ে এই ভাষার মর্যাদাকে আরো আরো বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
 
এসবের ধারাবাহিকতায় ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর ৩০তম অধিবেশনে ২১ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে পালনের স্বীকৃতি পাই আমরা। আর এই ভাষাকে হত্যা করতে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র করেছিলেন পাক শাসকরা। বাংলাভাষার সমর্থকরা ভারত ভাগের পূর্বেই উর্দুর বিরোধিতা করেছিলেন। ১৯৩৭ সালে মুসলিমলীগের লক্ষ্মৌ অধিবেশনে বাংলার সভ্যরা উর্দুকে ভারতের মুসলিমদের লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা মনোনয়নের প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়।ধর্মের তকমা লাগিয়ে রাষ্ট্র বানানো ছিল কায়েদ-ই আজম জিন্নাহ'র প্রথম ভুল। তিনি দ্বিতীয় ভুলটি করেন ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের নাগরিক জনসভায় যখন তিনি ঘোষণা দেন,'এটা আমি আপনাদেরকে পরিস্কার করে বলতে পারি যে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হতে যাচ্ছে উর্দু,অন্য কোনো ভাষা নয়'।এই ঘোষণার দুই দিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জনহলে বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পুন:রায় দম্ভোক্তি ছাড়েন তিনি, 'উর্দু,উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা'।
 
জিন্নাহ'র ভাগ্য ভালো,এই দম্ভোক্তির চরম পরিণতি তিনি দেখে যেতে পারেননি।১৯৪৮ সালের মার্চে এই ভাষণ দিয়ে সেপ্টেবরেই মারাযান তিনি।এই দম্ভোক্তির আগুন ফুলকি ধীরে ধীরে বাঙালির অন্তরে বিদ্রোহের দাবানল তৈরি করে।এমন অযৌক্তিক,উদ্ভট,চাপিয়ে দেওয়া,একরোখা হঠকারি সিদ্ধান্তকে বাঙালি কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারেনি।সারা দেশে প্রতিবাদেরর ঝড় ওঠে,পরিস্হিতি খারাপ দেখে ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে সমগ্র ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়।কিন্তু ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রজনতা এসবের তোয়াক্কা না করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সমাবেশ করেন। সমাবেশ শেষে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্রজনতা  প্রতিবাদী মিছিল বের করলে পুলিশ মিছিলে গুলি চালালে তাতে শহীদ হন ছালাম, রফিক, শফিক, জব্বার এবং বরকত, আহত হন আরো অনেকে।
 
ভাষা আন্দোলন ছিল মূলত একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও রাজনৈতিক আন্দোলন। এই আন্দোলন আমাদেরকে গভীর মনস্তাত্ত্বিক, দার্শনিক ও রাজনৈতিক উৎকর্ষতা দিয়েছে। এই আন্দোলন ছিল পূর্বপাকিস্তানের আপামর জনসাধারণের একটি ঐক্যবদ্ধ অসাম্প্রদায়িক আন্দোলন। অর্থাৎ অধিকার আদায়ে এক ও অভিন্ন হওয়ার মোক্ষম সুযোগ। এই আন্দোলনের ফলে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বোঝতে পেরেছিলেন পাক শাসকদের দূরভিসন্ধি,বিমাতাসুলভ আচরণ, শাসক-শোষিতের বিভাজন। ভবিষ্যৎ আন্দোলনের জন্যে আমাদের চেতনাকে দারুণ ভাবে শাণিত করেছিল এই বিয়োগাত্মক ঘটনা। সর্বোপরি আমাদের নতুন চোখ খুলে দিয়েছিল এই আন্দোলন।
 
তবে দু:খের বিষয় এত রক্ত,এত আবেগ-উচ্ছ্বাস,এত ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত আমাদের মাতৃভাষা তার সঠিক আসনটি এখনো পায়নি। এখনো এক শ্রেণির শিক্ষিত মানুষ ভিন দেশি ভাষা শেখা,ব্যবহার,লেখা তার বিস্তারকে গর্বের মনে করেন।তারা প্রায় সময় চলনে,বলনে,বাণী,ভাষণে, পঠন,পাঠনে শুদ্ধ বাংলাতো বলেনইনা,অশুদ্ধ ইংরেজি বলে পশ্চিমা পারিযায়ী পন্ডিত সেজে আত্মতৃপ্তি পান, নিজেকে হরপুনমৌলা ভাবেন। তাদের জন্যে মধ্যযুগের কবি আব্দুল হেকিম বলেছিলেন,'যে সবে বঙ্গেতে জন্মি, হিংসে বঙ্গবাণী, সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি'।
 
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, "ইংরেজি আমাদের কাজের ভাষা,ভাবের ভাষা বাংলা"।তাই বলে ভাষাআন্দোলনের ৬৮ বছর পরও আমাদের ডাক্তাররা ইংরেজিতে ব্যবস্হাপত্র লিখবেন, সুপ্রিমকোর্টে, হাইকোর্টে ইংরেজি ভাষায় বিচারকার্য পরিচালনা করবেন, মিডিয়ার উপস্হাপকরা আধাবাংলা আধাইংরেজিতে অনুষ্ঠান উপস্হাপন করবেন তা আমাদের ভাষাশহীদদের আত্মত্যাগকে কিছুটা হলেও ম্লান করে। যে ভাষার রয়েছে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, শরৎ, সুকান্ত; যে ভাষার রয়েছে হাজারো প্রবাদ-প্রবচন, লোকছড়া, যে ভাষায় পল্লীর পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে শত সহস্র প্রেমাখ্যান, জারি-সারি, বাউল, ভাটিয়ালি গান, যে ভাষায় মা শিশুকে ঘুম পাড়ান, মাঝি দাঁড় টানেন, চাষি জমি চাষ দেন,শ্রমিক তার গাইতি চালান, যে ভাষা সব সময় স্নিগ্ধ-স্নাত থাকে তের শত নদীর ভালোবাসায়, যে ভাষা উঠে এসেছে দোয়েলের শিস থেকে, মোরগের দৃপ্ত ভঙ্গিমা থেকে, অনাবিল দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ শ্যামলিমা থেকে,জনক-জননীর একান্ত আবেগ আত্ম অবগাহন থেকে, সে ভাষাইতো আমাদের চেতনার রঙ, প্রাণের গভীর উৎসারণ, হৃদয়ের একান্ত অনুরণন।
 
লেখক: কবি ও লেখক।

বিভাগ : মতামত


এই বিভাগের আরও