জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি চূড়ান্তকরণ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতে বিসিএমএ এর লবি

১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০৭:৪৯ পিএম | আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:৪৬ পিএম


জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি চূড়ান্তকরণ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতে বিসিএমএ এর লবি


জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি ২০১৯ চূড়ান্তকরণ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতে অর্থমন্ত্রণালয়ে জোর লবি শুরু করেছে সিগারেট কোম্পানিগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ সিগারেট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএমএ)। গত ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯ তারিখে অর্থ সচিব, স্বাস্থ্যসেবা সচিব এবং এনবিআর চেয়ারম্যানকে অনুলিপি দিয়ে মাননীয় অর্থমন্ত্রী বরাবর একটি চিঠি প্রেরণ করেছে সংগঠনটি।

চিঠিতে খসড়া জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি ২০১৯ এ অন্তর্ভুক্ত তামাক কোম্পানিতে সরকারি অংশিদারিত্ব বাতিল, তামাক খাতে বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং ইলেক্ট্রনিক সিগারেট নিষিদ্ধকরণ, প্লেইন প্যাকেজিং চালু ও সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তার আকৃতি/আয়তন বৃদ্ধি করা, সিগারেটের কর ও মূল্য বৃদ্ধি এবং সুনির্দিষ্ট করারোপের মতো তামাক নিয়ন্ত্রণের পরীক্ষিত পদ্ধতিসমূহ অন্তর্ভুক্ত না করতে মনগড়া ব্যাখ্যা ও ভিত্তিহীন যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়কে রাজস্ব ভীতি দেখিয়ে নীতিমালা ক্ষতিগ্রস্ত করতেই বিসিএমএ এই কূটকৌশল অবলম্বন করেছে। এর আগে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি প্রণয়ন বিষয়ক আন্ত:মন্ত্রণালয় সভা বাধাগ্রস্ত করতে সংঘবদ্ধ মিডিয়া ক্যাম্পেইন চালিয়েছিল তামাক কোম্পানিগুলো।


বিসিএমএ বাংলাদেশকে সিগারেটের উপর উচ্চ কর আরোপ করা দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হিসেবে অভিহিত করলেও বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশে সিগারেট অত্যন্ত সস্তা। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সবচেয়ে কমদামি সিগারেটের মূল্য বাংলাদেশের কমদামি সিগারেটের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৬ সালের তথ্যমতে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মিয়ানমার, নেপাল ও ইন্দোনেশিয়ার পরেই বাংলাদেশে সবচেয়ে কম দামে সস্তা ব্রান্ডের সিগারেট পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কর আরোপের মাধ্যমে তামাকপণ্যের সর্বনিম্ন মূল্য বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। চিঠিতে সিগারেটের কর বাড়ানোর সাথে রাজস্ব ফাঁকি দেয়া সিগারেট প্রচলন ও রাজস্ব হারানোর যে কল্পনাপ্রসূত যুক্তি বিসিএমএ তুলে ধরেছে তা কোনভাবেই সত্য নয়।

সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক তামাকপণ্যের অবৈধ বাণিজ্য নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে বলা হয়েছে বাংলাদেশে সিগারেটের অবৈধ বাণিজ্য ২৭টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম মাত্র ১.৮ শতাংশ। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, তামাকের ওপর কর বাড়ানোর সঙ্গে অবৈধ বাণিজ্য বৃদ্ধির তেমন কোনো সম্পর্কও নেই। তামাক পণ্যের ব্যবহার কমাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ প্লেইন প্যাকেজিং পদ্ধতির প্রচলনকে বিসিএমএ চিঠিতে অকার্যকর হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করেছে। অথচ, এর গুরুত্ব অনুধাবন করে থাইল্যান্ড, তুরস্ক, সৌদিআরব, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুরসহ কমপক্ষে ১৬টি দেশ এর অনুমোদন দিয়েছে।

এছাড়াও শ্রীলংকা, নেপালসহ আরো একাধিক দেশ প্লেইন প্যাকেজিং প্রথা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। এই পদ্ধতিতে তামাকপণ্যের প্যাকেট বা কৌটার গায়ে কোন প্রকার প্রচারণামূলক ও বিভ্রান্তিকর শব্দ ব্যবহারের সুযোগ থাকে না, যা ছবিযুক্ত স্বাস্থ্য সর্তকবাণীর কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বর্তমানে বাংলাদেশে তামাকপণ্যের প্যাকেটে ৫০ শতাংশ স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা মুদ্রণের বিধান রয়েছে। অথচ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে নেপালে ৯০ শতাংশ, ভারতে ৮৫ শতাংশ, থাইল্যান্ডে ৮৫ শতাংশ এবং শ্রীলংকায় ৮০ শতাংশ জায়গা জুড়ে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণীর প্রচলন রয়েছে। জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি এবং রাজস্ব সংরক্ষণের জন্য তামাক কোম্পানিতে সরকারি অংশিদারিত্ব ধরে রাখা দরকার বলে বিসিএমএ চিঠিতে উল্লেখ করেছে।

বাস্তবতা হলো, বহুজাতিক তামাক কোম্পানিতে সরকারের শেয়ার এবং কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে একাধিক সরকারি কর্মকর্তা মনোনিত থাকায় সরকারের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে তামাক নিয়ন্ত্রণ পদক্ষেপসমূহে হস্তক্ষেপ করা তামাক কোম্পানির জন্য সহজ হয়েছে। তামাক খাতে বৈদেশিক বিনিয়োগ নিষিদ্ধ না করার জন্য বিসিএমএ একাধিক যুক্তি তুলে ধরেছে, যার মধ্যে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি অন্যতম। এটি অত্যন্ত  হাস্যকর যুক্তি। আসল সত্য, ৪৯ শতাংশ তরুণ জনগোষ্ঠির এই দেশ এখন তামাক কোম্পানিগুলোর লোভনীয় বাজার।

জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ এখন ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট’ যুগে রয়েছে, অর্থাৎ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠির সংখ্যা এখন নির্ভরশীল জনগোষ্ঠির চেয়ে বেশি। অথচ তামাক ব্যবহারের ফলে এই কর্মক্ষম জনগোষ্ঠির একটা বড় অংশ অকালমৃত্যু এবং উৎপাদনশীলতা হারানোর ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, যা ভবিষ্যত প্রজন্মকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিবে। চিঠিতে ইলেক্ট্রনিক সিগারেট, ভ্যাপিং, হিটেড (আইকিউওএস) টোব্যাকো প্রোডাক্ট ইত্যাদিকে প্রথাগত সিগারেটের ‘নিরাপদ বিকল্প’ হিসেবে উপস্থাপন করে এগুলো বন্ধ না করার কথা বলা হয়েছে। তামাক কোম্পানিগুলো মূলত তরুণ এবং শিশুদের টার্গেট করে এসব পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করছে।  উদ্ভাবনী কৌশল এবং আকর্ষণীয় ডিজাইনের কারণে কিশোর এবং তরুণদের মাঝে বিশেষত বিদ্যালয়গামী শিশুদের মধ্যে এসব তামাকপণ্য জনপ্রিয়তা লাভ করতে শুরু করেছে। ইউরোপ, আমেরিকাসহ বেশ কিছু দেশে এসব পণ্য ব্যবহার ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। তবে বাংলাদেশে এখনো তা প্রকট আকার ধারণ করেনি। ইতোমধ্যে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ প্রায় ৪০টি দেশ এসব পণ্য নিষিদ্ধ করেছে।


উল্লেখ্য, বাংলাদেশে প্রতি বছর তামাক ব্যবহারের কারণে ১ লক্ষ ২৬ হাজারের অধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করে এবং তামাক ব্যবহারজনিত মৃত্যু ও অসুস্থতায় বছরে ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। তামাক ব্যবহারজনিত এই ক্ষয়ক্ষতি এবং ভয়াবহতা উপলব্ধি করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন এবং এলক্ষ্য অর্জনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ২০১৬ সালে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি প্রণয়নের কাজ শুরু করে।


তামাক নিয়ন্ত্রণের আন্তর্জাতিক চুক্তি ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) এর স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সকল তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা ও পদক্ষেপসমূহ তামাক কোম্পানির ব্যবসায়িক ও অন্যান্য স্বার্থ থেকে সুরক্ষা করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। সুতরাং সরকারকে তামাক কোম্পানির বিভ্রান্তিমূলক প্রচেষ্টা এবং হস্তক্ষেপমুক্ত থেকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি চূড়ান্তকরণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে, যা তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনের পথ সুগম করবে।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তি

 


বিভাগ : মতামত


এই বিভাগের আরও