একাত্তরের মার্চ : অগ্নিঝরা দিনগুলো

১১ মার্চ ২০২২, ০৭:৪৩ পিএম | আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:৪৭ এএম


একাত্তরের মার্চ : অগ্নিঝরা দিনগুলো

ড. মুহাম্মদ সোহরাওয়ার্দী

(পূর্ব প্রকাশের পর)

৭ মার্চ, রবিবার: পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড সকালে বঙ্গবন্ধুর বত্রিশ নম্বরের বাড়িতে একান্ত বৈঠক বলেন, ‘পূর্ববাংলায় স্বঘোষিত স্বাধীনতা হলে যুক্তরাষ্ট্র কা সমর্থন করবে না।’ বিকালে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) লক্ষ-লক্ষ জনতার এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে ঘোষণা করলেন, “...আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়। বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ অধিকার চায়...। তিনি আরো বলেন, ‘...তেইশ বছরের করুণ ইতিহাস ....বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস, তেইশ বছরের ইতিহাস মুমূর্ষূ নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস, বাংলার ইতিহাস এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।’ জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হওয়া সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘...যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে-আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও-একজন যদিও সে হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।’ বঙ্গবন্ধু আরো বলেন, ‘...আমরা পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরীব দুঃখী নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে। তার বুকের ওপর হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু। আমরা বাঙালীরা যখনই ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করেছি তখনই তারা আমাদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।’ ‘... রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি বলে দিয়েছি...শহীদের রক্তের উপর পা দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহামন যোগদান করতে পারে না।’ পঁচিশ তারিখে অনুষ্ঠেয় এ্যাসেম্বিলির অধিবেশন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘...আমার দাবি মানতে হবে প্রথম। সামরিক আইন মাশাল’ল উথড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষতা হস্তান্তর করতে হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না, আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই।’ বঙ্গবন্ধু আরো বলেন, ‘...আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাচারী, আদালত-ফৌজদারী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। ....শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিমকোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি-গবর্মমেন্ট দপ্তরগুলো, ওয়াপদা কোন কিছু চলবে না।’ আটাশ তারিখে কর্মচারিরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। এর পরে যদি বেতন দেয়া না হয়-আর যদি একটা গুলি চলে-আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়-তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে।’ সরকারি কর্মচারিদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘...আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমর এই দেশের মুক্তি না হবে খাজনা-ট্যাক্্র বন্ধ করে দেয়া হলো। কেউ দেবেন না।’ রেডিও টেলিভিশনের কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘... যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শুনে তাহলে কোন বাঙালী রেডিও স্টেশনে যাবেন না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয় কোন বাঙালী টেলিভিশনে যাবেন না।’ ব্যাংকিং সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ দুই ঘন্টা ব্যাংক খোলা থাকবে। যাতে মানুষ তাদের মায়নাপত্র নেবার পারে। কিন্তু পূর্ব বাংলার থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না।’তিনি সর্বশেষে বলেন, ‘ প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক।মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
ঢাকা বেতারে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ প্রচার না করার প্রতিবাদে বেতারে কর্মরত বাঙালি কর্মচারীরা কাজ বর্জন করেন। বিকেল থেকে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। প্রথমে জানানো হয়, বঙ্গবন্ধুর গুরুত্বপূর্ণ এ ভাষণ বেতারে প্রচার করা হবে। এ ঘোষণার পর সারা বাংলার শ্রোতারা অধীর আগ্রহে রেডিও নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। বেলা ২টা ১০ মিনিট থেকে ৩টা ২০ মিনিট পর্যন্ত ঢাকা বেতারে দেশাত্মবোধক রবীন্দ্রসংগীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ পরিবেশন করা হয়। গানটির পরিবেশনা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার করার মুহূর্তেই হঠাৎ ঢাকা বেতারের তৃতীয় অধিবেশনের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। সামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার বন্ধের প্রতিবাদে কাজ বন্ধ করে দেন বেতার কর্মীরা। অচল হয়ে পড়ে কেন্দ্র। পরে বেতার কর্মীদের দাবির মুখে গভীর রাতে সামরিক কর্তৃপক্ষ ঢাকা বেতারে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পূর্ণ বিবরণ প্রচারের অনুমতি দেয়।

৮ মার্চ, সোমবার: সকালে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দিয়েই দেশের সকল বেতার কেন্দ্র পুনরায় চালু হয়। দেশব্যাপী সর্বাত্নক অসহযোগ আন্দোলন চলতে থাকে। বেতার ও টেলিভিশন শিল্পীদের একটি প্রতিনিধি দল বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করেন। নুরুল আমিন ও খান এ সবুর পৃথক বিবৃতিতে আওয়ামীলীগের নিকট অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহবান জানায়। দেশের সকল প্রেক্ষাগৃহে পাকিস্তানী পতাকা প্রদর্শন, পাকিস্তানী সঙ্গীত বাজানো এবং উর্দু চলচ্চিত্র প্রদর্শন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়।
এই দিন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় সংগঠনের নাম পরিবর্তন করে শুধু ‘ছাত্রলীগ’ করা হয়। ছাত্রলীগের এ সভায় জেলা থেকে প্রাথমিক শাখা পর্যন্ত ‘স্বাধীন বাংলাদেশ সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সভায় পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন ও প্রদর্শন, জাতীয় সংগীত বাজানো এবং সিনেমা হলে উর্দু ছায়াছবির প্রদর্শনী বন্ধ করে দেওয়ারও সিদ্ধান্ত হয়। সারা দেশে ছাত্র, যুব ও পেশাজীবী সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে সংগ্রাম পরিষদ গঠনের জন্য তৎপরতা দেখা যায়।
ছাত্রলীগ এক বিবৃতিতে সশস্ত্র বাহিনীর গুলিতে বাংলাদেশের স্বাধিকার সংগ্রামের নিরস্ত্র বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সব সরকারি- বেসরকারি ভবনে অনির্দিষ্টকালের জন্য কালো পতাকা উত্তোলনের আহ্বান জানায়। পাড়ায় পাড়ায়, বাসভবনে, ছাত্রাবাসে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শীর্ষে কালো পতাকা ওঠানো হয়। সরকারি ও বেসরকারি যানবাহন এবং মোটরগাড়ি কালো পতাকা লাগিয়ে চলাচল করে। সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কর্মচারী সমিতি ও ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মোতাবেক অফিসের কাজ বর্জনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারী এবং সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মুক্তি আন্দোলনে নিহতদের শোকার্ত পরিবারের সাহায্যের জন্য এক দিনের বেতন সাহায্য তহবিলে দান করেন।

৯ মার্চ, মঙ্গলবার: দেশব্যাপী সর্বাত্নক অসহযোগ আন্দোলন চলতে থাকে। ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি কর্তৃক জেনারেল টিক্কা খানকে গভর্নর হিসেবে শপথ গ্রহণ করাতে অস্বীকৃতি। ছাত্রলীগ স্বাধীন বাংলাদেশ ঘোষণার প্রস্তাব অনুমোদন করে এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জাতীয় সরকার গঠনের আহবান জানায়। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ঢাকার পল্টনে এক জনসভায় পাকিস্তানকে দুই ভাগ করে দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আহবান জানান। পল্টন ময়দানের জনসভায় তুমুল করতালির মধ্যে ন্যাপ নেতা মাওলানা ভাসানী ইয়াহিয়া খানকে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা স্বীকার করে নিতে বলেন। তিনি বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশমতো ২৫ মার্চের মধ্যে কিছু না করা হলে শেখ মুজিবের সঙ্গে মিলে ১৯৫২ সালের মতো তুমুল গণ-আন্দোলন শুরু করবেন। মাওলানা ভাসানী তুমুল করতালি ও হর্ষধ্বনির মধ্যে বলেন, কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছে, শেখ মুজিবুর রহমান আপস করতে পারেন। কিন্তু শেখ মুজিব অবিশ্বাস করার মতো লোক নন। তিনি বলেন, ‘তাকে আমি রাজনীতিতে হাতেখড়ি দিয়েছি। আমি আমার রাজনৈতিক জীবনে বিভিন্ন সংগঠনের সভাপতি হিসেবে ৩১ জন জেনারেল সেক্রেটারির সাথে কাজ করেছি। তাঁদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানই ছিল শ্রেষ্ঠ সেক্রেটারি।’ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমেদ অসহযোগ আন্দোলন-সম্পর্কিত সংশোধিত নির্দেশ জারি করেন:
১. ব্যাংক: (ক) পূর্ব সপ্তাহের মতো মজুরি ও বেতনের টাকা প্রদান; (খ)১০০০ টাকা পর্যন্ত ব্যক্তিগত খরচের জন্য টাকা উত্তোলন; (গ) কল-কারখানা চালু রাখার লক্ষ্যে কাঁচামাল ক্রয়ের জন্য টাকা প্রদান।
২. স্টেট ব্যাংকের মাধ্যমে অথবা অন্য কোনভাবে টাকা পাঠানো বন্ধ।
৩. উপরোক্ত বিষয়গুলোর জন্য স্টেট ব্যাংক খোলা থাকবে।
৪. ইপি ওয়াপদা: বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য প্রয়োজনীয় শাখাগুলো খোলা থাকবে।
৫. ইপি এডিসি: সার ও পাওয়ার পাম্পের ডিজেল সরবরাহের কাজ করবে।
৬. ধান ও পাট বীজ সরবরাহ হবে এবং ইট পোড়াবার কয়লা দিতে হবে।
৭. খাদ্য পরিবহন অব্যাহত থাকবে।
৮. উপরের উল্লিখিত বিষয় সম্পর্কিত চালান পাশের জন্য ট্রেজারি ও এজি অফিস কাজ করবে।
৯. ঘুর্ণিঝড়বিধ্বস্ত এলাকায় রিলিফ বন্টন অব্যাহত থাকবে।
১০. বাংলাদেশের অভ্যন্তরে চিঠিপত্র, তার এবং মনিঅর্ডার পাঠানো অব্যাহত থাকবে।
১১. বাংলাদেশের সর্বত্র ‘ইপিআরটিও’ চালু থাকবে।
১২. গ্যাস ও পানি সরবরাহ অব্যাহত থাকবে।
১৩. স্বাস্থ্য ও স্যানিটারি সার্ভিসগুলো অব্যাহত থাকবে।
১৪. শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য পুলিশ স্বেচ্ছাসেবকের সহযোগিতা গ্রহণ করবে।
১৫. উপরে বর্ণিত আধা-সরকারি অফিসগুলো ছাড়া বাকি সব অফিসে হরতাল অব্যাহত থাকবে।
১৬. গত সপ্তাহে জারিকৃত অন্যান্য নির্দেশ বহাল থাকবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ক্যানটিনে সকালে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদের এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ছাত্র-জনসভায় গৃহীত ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ ঘোষণার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। আরেক প্রস্তাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশে ‘জাতীয় সরকার’ গঠনের জন্য অনুরোধ জানানো হয় এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আ স ম আবদুর রব ও আবদুল কুদ্দুস মাখনকে নিয়ে গঠিত ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’-এর ওপর স্বাধীনতা আন্দোলনের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়।

১০ মার্চ, বুধবার: স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এক ইশতেহারে বাঙালী সৈন্য, ইপিআর, আইবি, সিআইডি, পুলিশকে পাকিস্তানি প্রশাসনের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার আহবান জানায়। প্রবাসী ছাত্ররা জাতিসংঘ সদর দপ্তরের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। সারাদেশের সরকারি-বেসরকারি অফিসে মানচিত্র খচিত বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। সরকারি ও বেসরকারি ভবন, ব্যবসা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শীর্ষে কালো পতাকা ওড়ে। রাজারবাগ পুলিশ লাইনস, থানা ও হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির বাসভবনেও কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তিগত যানবাহনের পাশাপাশি পুলিশ বাহিনীর গাড়িগুলোও কালো পতাকা লাগিয়ে রাজপথে চলাচল করে। অনেক বাড়িতেও বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ছিল।
আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেন, ক্ষমতাসীন চক্র প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোবৃত্তি নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে গভীর চক্রান্তে লিপ্ত। তারা বাংলাদেশের সর্বত্র এক ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের ভীতসন্ত্রস্ত করে বাংলাদেশ ত্যাগে বাধ্য করছে। বঙ্গবন্ধু বলেন, জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট বাংলাদেশ থেকে জাতিসংঘের কর্মচারীদের অপসারণের অনুমতি দিয়েছেন। সামরিক বাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশে বসবাসরত বিদেশিদের জীবন ও সম্পদ কতটা বিপন্ন করে তুলেছেন, জাতিসংঘ মহাসচিবের এই নির্দেশে তারই স্বীকৃতি মেলে। জাতিসংঘ মহাসচিবের অনুধাবন করা উচিত, কেবল জাতিসংঘের কর্মীদের অপসারণ করলেই তাঁর দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। কেননা, যে হুমকি আজ উদ্যত, সেটি গণহত্যার। সে হুমকি বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য জাতিসংঘ সনদে সংরক্ষিত মৌলিক মানবাধিকার অস্বীকৃতিরই নামান্তর। ধ্বংসকারী যত অস্ত্রেই সুসজ্জিত থাকুন না কেন, কোনো শক্তিই আর বাঙালিদের চূড়ান্ত বিজয় থেকে বঞ্চিত করতে পারবে না। ছাত্রলীগ ও ডাকসু নেতাদের স্বাক্ষরিত স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্য আরেকটি বিবৃতিতে বাঙালি সেনা, ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের প্রতি পাকিস্তানি উপনিবেশবাদী সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা না করার আবেদন জানানো হয়। অন্য দিনগুলোর মতো এদিনও ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে সামরিক প্রশিক্ষণ নেন ও কুচকাওয়াজ করেন। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ শেষে মিছিল বের করা হয়।
‘লেখক-শিল্পী মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ’-এর ব্যানারে লেখক ও শিল্পীরা ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। মিছিল বায়তুল মোকাররম থেকে শহীদ মিনার পর্যন্ত যায়। ফরোয়ার্ড স্টুডেন্ট ব্লক বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে জনসমাবেশের আয়োজন করে। সিভিল সার্ভিসের দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের প্রতিনিধিরা সভায় মিলিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনে চলার আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নেন। চলচ্চিত্র প্রদর্শকেরা অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ঢাকাসহ সারা দেশে অনির্দিষ্টকাল প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেন। রাজশাহী শহরে অনির্দিষ্টকালের জন্য জারি করা নৈশ কারফিউ প্রত্যাহার করা হয়। নিউইয়র্কে প্রবাসী বাঙালি ছাত্ররা জাতিসংঘ সদর দপ্তরের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। তাঁরা পাকিস্তানি সামরিক জান্তার নির্বিচার হত্যা ও অত্যাচারের প্রতিবাদ জানান। নৃশংস হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার জন্য তাঁরা জাতিসংঘকে হস্তক্ষেপ করার আহ্বান জানান। সকালে বঙ্গবন্ধু তাঁর বাসভবনে একদল বিদেশি সাংবাদিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকার বৈঠকে মিলিত হন। বঙ্গবন্ধু তাঁদের বলেন, এ পর্যন্ত বাঙালিরা অনেক রক্ত দিয়েছে। এবার রক্ত দেওয়ার পালা শেষ করার সময় এসেছে। বাঙালি চায় রাজনৈতিক ও অর্ধনৈতিক মুক্তি। বঙ্গবন্ধু তাঁদের বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমরা কোনো আপস করব না।’ পাকিস্তানের সমরাস্ত্র নিয়ে আসা জাহাজ ‘এম এল সোয়াত’ এই দিন চট্টগ্রাম বন্দরের ১৭ নম্বর জেটিতে নোঙর করে। জাহাজ থেকে নামিয়ে সমরাস্ত্রগুলো বিভিন্ন সেনাছাউনিতে পাঠানোর জন্য বন্দরের বাইরে ওয়াগন প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। চট্টগ্রাম বন্দরের শ্রমিকেরা এসব সমরাস্ত্র জাহাজ থেকে নামানোর নির্দেশ অগ্রাহ্য করেন। সামরিক বাহিনীকে দিয়ে সমরাস্ত্র ও গোলাবারুদ নামানোর ব্যবস্থা করতে গেলে উপস্থিত জনগণের প্রতিরোধে তা নস্যাৎ হয়ে যায়।

১১ মার্চ, বৃহস্পতিবার: মাওলানা ভাসানী টাঙ্গাইলে এক জনসভায় বলেন, স্বাধীনতা ছাড়া আপোসের কোন পথ খোলা নেই। সিএসপি ও ইপিএস সমিতির পদস্থ বাঙালি সরকারি কর্মচারিরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনে সমর্থন জানান। তারা আওয়ামীলীগের তহবিলে একদিনের বেতন প্রদান করেন। নারয়ণগঞ্জে ছায়াছবি প্রদর্শনের পূর্বে পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীতের পরিবর্তে ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানটি পরিবেশন করা হয়।স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের চার নেতা এক যুক্ত বিবৃতিতে পাকিস্তান সরকার প্রদত্ত যাবতীয় খেতাব ও পদক বর্জনের আহবান জানান।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ১১ মার্চ এক বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে ১৪টি নির্দেশ জারি করেন। মূলত সরকারি অফিস, ব্যাংক-বিমা ও অন্যান্য সংস্থা কীভাবে চলবে এবং কী কী বিধিনিষেধ মেনে চলবে বিবৃতিতে সেই নির্দেশনা দেওয়া হয়।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে অন্যান্য দিনের মতো এই দিনও স্টেট ব্যাংক, তফসিলি ব্যাংক ও সরকারি ট্রেজারিতে স্বাভাবিক লেনদেন চলে। বাংলাদেশের ভেতরে ডাক, তার ও টেলিফোন যোগাযোগ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচল ছাড়া সড়ক, রেল ও নৌ চলাচল অব্যাহত থাকে। বিপণিগুলো সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত খোলা থাকে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন ও পেশাজীবী প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে ঢাকায় সভা, সমাবেশ ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব বাংলার আন্দোলনরত গণমানুষের প্রতি তাজউদ্দীন আহমদের বিবৃতিতে যে নির্দেশনা দেন সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
* বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বাংলাদেশের ভেতরে যেকোনো অঙ্কের অর্থ জমা হিসেবে গ্রহণ ও আন্ত:ব্যাংক ক্লিয়ারেন্সসহ সব ধরনের ব্যাংকিং কাজ করতে পারবে।
* ধান, পাটবীজ, সার ও কীটনাশক সংগ্রহ, পরিবহন ও বিতরণ অব্যাহত থাকবে।
* কৃষি খামার এবং চাল গবেষণা কেন্দ্রের কাজ চালু থাকবে।
* বন্দর কর্তৃপক্ষের কাজ চলবে। সেনাবাহিনীর চলাচল অথবা জনসাধারণের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে পারে, এমন সামগ্রী খালাসের ব্যাপারে কোনো সহযোগিতা করা যাবে না।
* ইস্ট পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের (ইপিআইডিসি) সমস্ত কলকারখানায় কাজ চলবে এবং উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা চালাতে হবে।
* ঘূর্ণিঝড়দুর্গত এলাকায় বাঁধ নির্মাণ ও উন্নয়ন কাজসহ সব সাহায্য, পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন কাজ চলবে।
* পল্লি­অঞ্চলে উন্নয়নকাজ অব্যাহত থাকবে।
* সরকারি ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক ও কর্মচারীর মজুরি ও বেতন পাওনা হলে তা পরিশোধ করতে হবে।
*হিসাব নিরীক্ষণ অফিসে আংশিক কাজ চলবে।
* জেলখানার ওয়ার্ডে ও অফিসে কাজ চলবে।
* বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিযুক্ত শাখাগুলো চালু থাকবে।
সংগ্রামী জনতা ঢাকায় সেনাবাহিনীর রসদ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর স্বাভাবিক সরবরাহের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে। সিলেটে রেশন নেওয়ার সময় সেনাবাহিনীর একটি গাড়িকে বাধা দেওয়া হয়। যশোর ও অন্য এলাকাতেও এ ধরনের ঘটনা ঘটে। টাঙ্গাইলে বিন্দুবাসিনী হাইস্কুল ময়দানে এক জনসভায় মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বঙ্গবন্ধু ঘোষিত স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ঘোষণা করেন। তিনি তাঁর সমর্থকদের উদ্দেশে বলেন, জনগণ এখন নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এ মুহূর্তে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো রকম বিভেদ থাকা উচিত নয়। শেখ মুজিবুর রহমান এখন সাত কোটি বাঙালির নেতা। তিনি বলেন, ‘নেতার নির্দেশ পালন করুন।’

১২ মার্চ, শুক্রবার: সারা দেশে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অসযোগ আন্দোলন, স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন, সভা সমাবেশ অব্যাহত থাকে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবানে জাতীয় পরিষদের সদস্য মোহাম্মদ জহিরউদ্দিন পাকিস্তানের খেতাব বর্জন করেন। সারাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শকরা অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থনে সকল প্রেক্ষাগৃহ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ময়মনসিংহে এক জনসভায় মাওলানা ভাসানী জনগণকে শেখ মুজিবের উপর ভরসা রাখার আহবান জানান। বাঙালি সিএসপি কর্মকর্তারা অসহযোগ আন্দোলনে সংহতি জ্ঞাপন করে মিছিল করেন। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার ২৩ মার্চের পাকিস্তান প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠান বাতিল ঘোষণা করে। দিবসটি উপলক্ষে আয়োজিত সশস্ত্র বাহিনীর সম্মিলিত কুচকাওয়াজ, খেতাব বিতরণ ও অন্যান্য অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়। সরকারি-আধা সরকারি কর্মচারীরা এই দিনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কর্মস্থল বর্জন অব্যাহত রাখেন। সারা বাংলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তালা ঝোলে। সরকারি ও বেসরকারি ভবন, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বাসগৃহ ও যানবাহনে উড়ছিল কালো পতাকা। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ছাত্র, শ্রমিক ও পেশাজীবী সংগঠনের উদ্যোগে সভা-সমাবেশ ও শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। একই দিন সংগ্রাম পরিষদ গঠনের মাধ্যমে স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য শপথ নেওয়া হয়।
আর্টস কাউন্সিলে চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ সৈয়দ শফিকুল হোসেনের সভাপতিত্বে চারু ও কারুশিল্পীদের এক সভায় মুর্তজা বশীর ও কাইয়ুম চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। পরিষদ স্বাধিকার আন্দোলনে বাংলার জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে তোলার উদ্দেশ্যে সাইক্লোস্টাইল করা দেশাত্মবোধক ও সংগ্রামী স্কেচ বিতরণ, পোস্টার ও ফেস্টুন প্রচার, পোস্টার-ফেস্টুনসহ মিছিল আয়োজন করার কর্মসূচি নেয়। ১৬ মার্চ বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করারও সিদ্ধান্ত হয়। রেডিও পাকিস্তানের করাচি কেন্দ্রের বাংলা সংবাদপাঠক সরকার কবীর উদ্দিন বেতারে বঙ্গবন্ধুর খবর প্রচারে নিয়ন্ত্রণ আরোপের প্রতিবাদে রেডিও পাকিস্তান বর্জন করেন।

১৩ মার্চ, শনিবার: সরকার সামরিক ফরমানের ১১৫ নং অধ্যাদেশ জারি করে প্রতিরক্ষা বাজেট হতে যেসব কর্মচারিকে বেতন প্রদান করা হয় তাদেরকে ১৫ মার্চ সকাল ১০ টার মধ্যে কাজে যোগদানের নিদের্শ প্রদান করে।
নির্দেশে হুমকি দিয়ে বলা হয়, যারা কাজে যোগ দেবে না, তাদের চাকরিচ্যুত ও পলাতক ঘোষণা করে সামরিক আদালতে বিচার করা হবে।সামরিক নির্দেশ জারির পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেন, সামরিক শাসন প্রত্যাহারের জন্য বাংলার জনগণের দাবির কথা ঘোষণা করার পর নতুন করে এ ধরনের সামরিক নির্দেশ জারি করা, পক্ষান্তরে জনসাধারণকে উসকানি দেওয়ার শামিল। সামরিক কর্তৃপক্ষের এই সত্যটি উপলব্ধি করা উচিত, জনগণ সংকল্পে ঐক্যবদ্ধ। সামরিক সরকারের ভীতি প্রদর্শনের মুখে তারা কিছুতেই নতি স্বীকার করবে না। সামরিক কর্তৃপক্ষকে বঙ্গবন্ধু উসকানিমূলক তৎপরতা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান।
দেশ উত্তাল। সরকারি-বেসরকারি সব কাজকর্ম বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চলা অব্যাহত ছিল। চলমান অসহযোগ আন্দোলনে বাংলার দেওয়ানি-ফৌজদারি আদালতসহ সব সরকারি ও আধা সরকারি অফিস এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। ভবনের শীর্ষে কালো পতাকা। ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে দিনভর অবিরাম চলে সভা-শোভাযাত্রা। ৭ মার্চ রেসকোর্সের ময়দানে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশের নানা অঞ্চলে এই দিনেও গড়ে উঠেছে সংগ্রাম কমিটি। ভৈরবে মাওলানা ভাসানী বলেন, ভুট্টোর উচিত পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা। আমরা আমাদের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করব। ন্যাপের ওয়ালী খান ঢাকায় আসেন এবং বঙ্গবন্ধুর দাবি অনুসারে সামরিক আইন প্রত্যাহার ও জনপ্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের সঙ্গে একাত্নতা ঘোষণা করেন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবানে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও সাবেক জাতীয় পরিষদ সদস্য আবদুল হাকিম পাকিস্তান সরকার প্রদত্ত খেতাব ও পদক বর্জন করেন। সকালে ঢাকার রমনা পার্কে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকার অদূরে শীতলক্ষ্যা নদীতে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের উদ্যোগে বের হয় দীর্ঘ নৌ মিছিল। অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থনে উমরতুল ফজলের সভাপতিত্বে চট্টগ্রামে নারীদের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে বাংলাদেশের মানুষের পরিপূর্ণ মুক্তি অর্জন না হওয়া পর্যন্ত বিলাসদ্রব্য বর্জন ও কালো ব্যাজ ধারণের জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানানো হয়। লাহোরে জাতীয় পরিষদের সংখ্যালঘিষ্ঠ পাঁচটি দলের পার্লামেন্টারি পার্টির নেতারা একটি সভায় মিলিত হয়ে দ্রুত সামরিক শাসন প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান।

১৪ মার্চ, রোববার: স্বাধীনতার দাবিতে সারা বাংলা উত্তাল। বিক্ষোভ-সমাবেশের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে চলছিল সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন। স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ দেশ থেকে সম্পদ পাচার প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে চেকপোস্ট স্থাপন করে।
সামরিক কর্তৃপক্ষের ১১৫ নম্বর নির্দেশের প্রতিবাদে দেশ রক্ষা বিভাগের বেসামরিক কর্মচারীরা সকালে ঢাকায় বিক্ষোভ করেন। সরকারি কর্মচারী সমন্বয় কাউন্সিলের বিবৃতিতে সামরিক নির্দেশ কার্যকর না করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থনে সংবাদপত্র প্রেস কর্মচারী ফেডারেশনের উদ্যোগে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে সমাবেশ হয়। ডিআইটি ভবন প্রাঙ্গণে সমাবেশ করেন টিভি নাট্যশিল্পীরা। সভায় অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করা হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ে কর্মসূচিন শেষ দিন। বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত রাখার জন্য ৩৫টি নির্দেশনা জারি করেন। এ নির্দেশনার মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রশাসনভার কার্যত বঙ্গবন্ধু গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরেরা যাতে স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে স্বাধীন হয়ে মর্যাদার সঙ্গে বাস করতে পারে তার নিরাপত্তা বিধান করার জন্য আমরা প্রত্যেকে প্রয়োজনে মরতেও সংকল্পবদ্ধ। যেকোন ত্যাগের জন্য তৈরি থাকতে হবে এবং আমাদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করা হলে সর্বোপরি তা প্রতিহত করার জন্য জনসাধারণকে প্রস্তুত থাকতে হবে। ১১৫ নং সামরিক বিধি জারির প্রতিবাদে দেশরক্ষা বিভাগের বাঙালি বেসামরিক কর্মচারিরা ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিল বের করে এবং মিছিল শেষে বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করেন। সকালে ন্যাপ নেতা খান আবদুল ওয়ালি খানের সঙ্গে এক বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু তাঁর বাসভবনের আঙিনায় অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। এক বিদেশি সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, আপনি কি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করবেন? জবাবে বঙ্গবন্ধু পাল্টা জিজ্ঞেস করেন, প্রেসিডেন্ট কি ঢাকায় এসেছেন? প্রশ্নকর্তা জবাব দেন, না। বঙ্গবন্ধু তখন আবার প্রশ্ন করেন, তাহলে দেখা হবে কীভাবে? প্রশ্নকর্তা নিরুত্তর। এরপর বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ঢাকায় এলে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে আমি রাজি আছি।’ রাতে দীর্ঘ এক বিবৃতির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগণের মুক্তির আকাঙ্খাকে নির্মূল করা যাবে না। বাংলাদেশের সরকারি কর্মচারী, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, জনতা অকুণ্ঠচিত্তে জানিয়ে দিয়েছেন, আত্মসমর্পণ নয়, তাঁরা আত্মত্যাগের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। করাচিতে পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) এক জনসভায় দলের প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের দুই অংশের দুই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার প্রস্তাব দেন। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা হিসেবে তাঁর সঙ্গে সংলাপ শুরু করার জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ চায়, দেশের দুই অংশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দুটি দলই একসঙ্গে কাজ করুক। তিনি বলেন, ছয় দফার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ প্রকৃত প্রস্তাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাই দাবি করছে।

১৫ মার্চ সোমবার: আগের দিনের ছড়ানো গুজবকে সত্যি করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৫ মার্চ বিকেলে করাচি থেকে ঢাকায় আসেন। বিমানবন্দরে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান তাঁকে স্বাগত জানান। কোনো সাংবাদিক বা বাঙালিকে বিমানবন্দরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সারা বাংলায় সরকারি-আধাসরকারি অফিস, আদালতে পূর্ণ দিবস কর্মবিরতি পালন করা হয়। দেশরক্ষা বিভাগের বেসামরিক কর্মচারীরা সামরিক নির্দেশ উপেক্ষা করে কর্মস্থলে যোগ দেননি। তাঁরা নাখালপাড়ায় একটি সভা করেন। সভাশেষে রাজপথে বের করেন বিক্ষোভ মিছিল।
সরকারি-বেসরকারি ভবন শীর্ষে এবং যানবাহনে কালো পতাকা ও স্বাধীন বাংলার মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন করা হয়। সামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশ উপেক্ষা করে সকালে বেসামরিক কর্মচারিদের সভা ও রাজপথে বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। পিপিপি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানে এ বিবৃতিতে বলেন, ‘কেন্দ্রের ক্ষমতা দেশের দুই অংশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলগুলোর কাছে এবং প্রদেশগুলোর ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে হস্তান্তর করতে হবে।’ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ এক বিবৃতিতে বলেন, বঙ্গবন্ধুর অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে জনগণ অভূতপূর্ব সাড়া দিয়েছে। ১৪ মার্চ যেসব নির্দেশ জারি করা হয়েছে, তিনি তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে সর্বশক্তি নিয়োগ করে তা মেনে চলার অনুরোধ জানান।
সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসকেরা সমাবেশ-শোভাযাত্রা করেন। সন্ধ্যায় বেতার-টিভির শিল্পীরা সেখানে দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করেন। বিকেলে তোপখানা রোডে সুফিয়া কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় নারী সমাবেশ। উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর শিল্পীরা ট্রাকে চড়ে নগরীর নানা স্থানে গণসংগীত ও পথনাটক পরিবেশন করেন। নতুন সামরিক বিধি জারির প্রতিবাদে বিকেলে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে ছাত্র জমায়েত করে স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। রাতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত চেকপোস্ট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়। বাংলা থেকে অর্থ ও সম্পদ পাচার বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত চেকপোস্টের কারণে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হওয়ায় প্রত্যাহার করা হয়। তবে কোনোক্রমেই যেন সম্পদ পাচার হতে না পারে, সেদিকে লক্ষ রাখার অনুরোধ জানানো হয়। দেশজুড়ে সরকারি খেতাব বর্জন করতে শুরু করেন বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। দৈনিক পাকিস্তান-এর সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন তাঁর দুই খেতাব ‘সিতারা-এ-খিদমত’ ও ‘সিতারা-এ-ইমতিয়াজ’ বর্জন করেন। নাট্যকার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীও পরিত্যাগ করেন তাঁর ‘সিতারা-এ-ইমতিয়াজ’ খেতাব। নাটোর থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য ডাক্তার শেখ মোবারক হোসেন তাঁর ‘তমঘা-এ-কায়েদে আজম’ খেতাব বর্জন করেন। (চলবে...)


বিভাগ : মতামত


এই বিভাগের আরও