একাত্তরের মার্চ : অগ্নিঝরা দিনগুলো

০৬ মার্চ ২০২২, ১০:৫৭ পিএম | আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:৩৯ পিএম


একাত্তরের মার্চ : অগ্নিঝরা দিনগুলো

ড. মুহাম্মদ সোহরাওয়ার্দী

বাঙালীর জাতিসত্তা ও স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে বহু শতাব্দীর সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমায় ছাব্বিশ মার্চ এক অবিস্মরণীয় দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্ররূপে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। স্বাধীনতা কিংবা আজকের বাংলাদেশ একদিনে অর্জিত হয়নি। সুদীর্ঘকাল ধরে পরিচালিত বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যদিয়ে অনেক ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে সৃস্টি হয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ১৯৭০ সালের নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত। এ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ জাতীয় পরিষদে ১৬৭ টি আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদে ২৯৮ টি আসন লাভ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল নির্বাচিত হয়। মূলত ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মধ্যদিয়ে বৈধ নেতৃত্ব নির্বাচিত হওয়ার পাশাপাশি পাকিস্তানের রাজনৈতিক মৃত্যু ঘটে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে অগ্নিঝরা মার্চের দিনগুলো বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

১ মার্চ, সোমবার: প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১.০৫ মিনিটে এক বেতার ভাষণে আকস্মিকভাবে ৩ মার্চ তারিখের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্ঠকালের জন্য স্থগিত করলে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস-আদালত, কলকারখানা, দোকানপাট, যানবাহন সব বন্ধ হয়ে যায়। জনতার বিক্ষুভে ঢাকা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড ও কমনওয়েলথ একাদশের মধ্যকার ক্রিকেট ম্যাচ ভন্ডুল হয়ে যায়। ঢাকা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত খেলায় আগত চল্লিশ-পঞ্চাশ হাজার দর্শক সবাই “জয় বাংলা” স্লোগান দিতে দিতে মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। স্লোগান উঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো হতে। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় সভা শেষে রাজপথে মিছিল নেমে আসে ছাত্ররা। এই প্রথম রাজপথে, প্রকাশ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জনগণ স্বাধীনতার স্লোগান আপনা-আপনিই তুলে নিল। ‘ইয়াহিয়ার ঘোষণা, বাঙালিরা মানে না’, ‘পাকিস্তানের পতাকা, জ্বালিয়ে দাও, পুড়িয়ে দাও’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘জিন্না মিয়ার পাকিস্তান, আজিমপুরের গোরস্থান’ ইত্যাদি স্লোগান তুলে জনতা এগিয়ে যায়।’
আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি পার্টির সভায় যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে হোটেল পূর্বাণীতে সমবেত নির্বাচিত সদস্যরা বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠক শেষে হোটেল পূর্বাণীতে অনুষ্ঠিত সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কর্তৃক জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্ঠকালের জন্য স্থগিত ঘোষণার তীব্র প্রতিবাদ জানান। তিনি জনগণকে ধৈর্য ধরতে আহবান জানান। বঙ্গবন্ধু সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাংলার মানুষ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার এই সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করেছে। ইয়াহিয়ার এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ২ মার্চ ঢাকা শহরে ও ৩ মার্চ প্রদেশব্যাপী হরতাল আহবান ও ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসভা অনুষ্ঠানের ঘোষণা করেন। সারা শহর মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়। মিছিল স্লোগান উঠে “তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা-মেঘনা-যমুনা”, “তোমারদেশ-আমারদেশ বাংলাদেশ-বাংলাদেশ”, “জাগো জাগো বাঙ্গালী জাগো,” “বীব বাঙালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর”।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। স্বাধিকারের আন্দোলন ধীরে ধীরে স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নিতে থাকে। রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে (বর্তমানে জহুরুল হক হল) ছাত্রলীগের সাবেক ও তৎকালীন ছাত্রনেতারা এক যৌথসভায় মিলিত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা এবং জাতীয় সংগীতের কাঠামো ও রূপ নিয়ে কথা বলেন। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় পরদিন ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্রলীগের সভায় ‘স্বাধীনতার প্রস্তাব’ পাঠ করা হবে। সরকার মিছিল বন্ধ করার জন্য কারফিউ জারি করে। গভীর রাতে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক এক আদেশে সংবাদপত্রে দেশের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে কোনো খবর বা ছবি প্রকাশ না করার নির্দেশ করে বলেন, এ আইন ভাঙা হলে সামরিক আইনবিধি মোতাবেক সর্বোচ্চ ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হবে।

২ মার্চ, মঙ্গলবার: বঙ্গবন্ধুর আহবানে ঢাকায় হরতাল পালিত হয়। হরতালে অচল ঢাকা মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়েছিল। জনগণ দ্ব্যর্ধহীনভাবে জানিয়ে দেয়, স্বাধিকারের প্রশ্নে কোনো আপস নেই। সকাল থেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঢাকার সব দোকানপাট, ব্যবসাকেন্দ্র, যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত কোনো প্রতিষ্ঠানেই কর্মচারীরা কাজে যোগ দেননি। রেল ও বিমান সম্পূর্ণভাবে বন্ধ থাকে। হাজার হাজার মানুষ লাঠিসোঁটা হাতে রাজপথে নেমে আসে। বেলা ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্রলীগ ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে ছাত্র সমাবেশ হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় শিব নারায়ন দাস এর পরিকল্পনা ও অঙ্কিত লাল-সবুজ-সোনালী এ তিন রঙের বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলার জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন ডাকসুর ভিপি আ.স.ম আব্দুর রব। তখন মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ, ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখন। সেখানে উত্তোলিত পতাকাই সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস কার্যত বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার রূপ লাভ করে। প্রবাসী মুজিবনগর সরকারও এই পতাকাকেই জাতীয় পতাকা হিসেবে ব্যবহার করে। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভা শেষে এক বিরাট শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা শহরে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। সকাল ১১ টার দিকে ফার্মগেটে বিক্ষুদ্ধ জনতার ওপর সামরিক বাহিনীর গুলি বর্ষণ ও বেয়নেট চার্জে ৯ জন হতাহত হন। বিকেলে বায়তুল মোকাররম ও পল্টনে অনুষ্ঠিত হয় জনসভা। সন্ধ্যায় ক্লান্ত-শ্রান্ত মানুষ ঘরে ফেরে। কিন্তু সন্ধ্যার পর হঠাৎ শহরে কারফিউ জারির ঘোষণায় বিক্ষুব্ধ জনগণ আবার রাজপথে নেমে আসে।
সামরিক কর্তৃপক্ষ এদিন কারফিউ জারি করেছিল রাত নয়টা থেকে পরদিন সকাল সাতটা পর্যন্ত। পরে অনির্দিষ্টকালের জন্য প্রতিদিন সন্ধ্যা সাতটা থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত কারফিউ ঘোষণা করা হয়। রেডিওতে কারফিউ জারির ঘোষণা শুনে বিভিন্ন এলাকায় জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে এসে ব্যারিকেড দেয়। গভীর রাত পর্যন্ত কারফিউ ভেঙে মিছিল করে। মিছিলে স্লোগানের পাশাপাশি মাঝেমধ্যে শোনা যায় গুলিবর্ষণের আওয়াজ। রাতে বিক্ষোভকারীদের ওপর নির্বিচার গুলিবর্ষণে শতাধিক ব্যক্তি হতাহত হয়। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নগরীর হাসপাতালগুলোতে বুলেটবিদ্ধ মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে।
এ দিন এক বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন, “গণবিরোধী শক্তির সাথে কোন সহযোগিতা না করা, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে কোন ষড়যন্ত্র সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করা সরকারি কর্মচারিসহ প্রতিটি পেশার বাঙ্গালীর পবিত্র দায়িত্ব। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই ক্ষমতার একমাত্র বৈধ উৎস।” বঙ্গবন্ধু জনগণের দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রসঙ্গে বলেন, ‘এই সংকটের সন্ধিক্ষণে সরকারি কর্মচারীসহ সর্বস্তরের প্রত্যেক বাঙালির পবিত্র কর্তব্য হচ্ছে গণবিরোধী শক্তির সঙ্গে অসহযোগিতা করা এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পরিচালিত ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেওয়ার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করা।’ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তাজউদ্দিন আহমদ, ড. কামাল হোসেন ও আমীর-উল-ইসলাম আওয়ামীলীগের পক্ষ হতে আন্দোলনের বিভিন্ন নির্দেশ জারি করেন। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে নির্দেশগুলো হলো:
১. ৩ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ছয়টা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত সমগ্র প্রদেশে হরতাল পালন;
২. ৩ মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত হওয়ায় সেই দিনকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন;
৩. রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রে বাঙালি জনগণের কর্মতৎপরতার বিবরণী বা বিবৃতি প্রকাশ করতে দেওয়া না হলে এসব প্রতিষ্ঠানের বাঙালি কর্মচারীদের বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষের কণ্ঠরোধের চেষ্টা নাকচ করে দেওয়া;
৪. ৭ মার্চ বেলা দুইটায় রেসকোর্স ময়দানে গণসমাবেশে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দেওয়ার ঘোষণা;
৫. সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সংগ্রাম চালানোর আহ্বান।
২ মার্চ প্রচারিত প্রথম নির্দেশপত্রে ৩ থেকে ৬ মার্চ ১৯৭১ প্রতিদিন ভোর ৬ টা থেকে ২টা পর্যন্ত প্রদেশব্যাপী হরতাল আহবান করা হয়। সরকারি দপ্তরসমূহ, সচিবালয়, হাইকোর্ট ও অন্যান্য আদালত, সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত কর্পোরেশসমূহ যেমন: ডাক বিভাগ, রেলওয়ে ও অন্যান্য যোগাযোগব্যবস্থা, সরকারি-বেসরকারি পরিবহন, কলকারখানা, শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, দোকানপাট সবকিছুই হরতালের আওতাভূক্ত। কেবল অ্যামবুলেন্স, সংবাদপত্রের গাড়ি, হাসপাতাল, ওষুধের দোকান এবং বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহব্যবস্থাকে হরতালের আওতামুক্ত রাখা হয়। এসব নির্দেশের ফলে দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা হয়।

৩ মার্চ, বুধবার: বঙ্গবন্ধুর আহবানে সারাদেশে হরতাল পালিত হয়। ২ মার্চ দিবাগত রাতে শহীদদের লাশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের ইকবাল হল (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক) থেকে শোকযাত্রা ও খন্ড মিছিল বের হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষবৃন্দ শোক মিছিল বের করে শহীদ মিনারে সমবেত হন। হরতাল চলাকালে প্রদেশব্যাপী সেনাবাহিনীর গুলিতে কয়েকজন প্রাণ হারান। বিকালে পল্টন ময়দানে এক জনসভায় বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হয়। এ দিন ছাত্রলীগ আয়োজিত পল্টনের জনসভায় গৃহীত প্রস্তাবাবলী ছিল:
১। পাকিস্তানী সশস্র সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত বাঙালী ভাইদের বিদেহী আত্নার মাগফেরাত কামনার পাশাপাশি শোকসন্তপ্ত পরিবার পরিজনের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন এবং পাকিস্তানী উপনেবেশিক শক্তি সেনাবাহিনীর এ জঘন্য হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলা;
২। ভাড়াটিয়া সেনাবাহিনীর গুলিতে আহত স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী বীর বাঙালি ভাইদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য স্বাস্থ্যবান বাঙালি ভাইদের ব্লাডব্যাংকে রক্ত প্রদানের আহবান জানানো হয়;
৩। পাকিস্তান উপনিবেশবাদের কবল হতে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা, শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের জন্য সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ও নির্ভেজাল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশে কৃষক-শ্রমিক রাজ কায়েমের শপথ গ্রহণ;
৪। স্বাধীন বাংলার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পূর্ণ আস্থা রেখে তাঁর সফল সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ;
৫। দলমত নির্বিশেষে বাংলার প্রতিটি নরনারীকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম চালিয়ে যাবার আহবান জানানো হয়।
পল্টন ময়দানে নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে ছাত্রলীগের আয়োজিত বিশাল জনসভায় স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রস্তাবিত জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন ও জাতীয় পতাকা প্রদর্শিত হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন ও স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ঘোষণাপত্র প্রচার করা হয়। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ঘোষণা ও কর্মসূচি শিরোনাম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইশতেহার তুলে ধরেন। এ ইশতেহারে উল্লেখ করা হয়:


জয় বাংলা
ইশতেহার নং/এক
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ঘোষণা ও কর্মসূচী
(ছাত্রলীগ)

স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ ঘোষণা করা হয়েছে:
গত তেইশ বছরের শোষণ, কুশাসন ও নির্যাতন এ’কথা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত করেছে যে, সাত কোটি বাঙ্গালীকে গোলামে পরিণত করার জন্যে বিদেশী পশ্চিমা উপনিবেশবাদীদের যে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র তা থেকে বাঙ্গালীর মুক্তির একমাত্র পথ স্বাধীন জাতি হিসেবে স্বাধীন দেশের মুক্ত নাগরিক হয়ে বেঁচে থাকা। গত নির্বাচনের গণরায়কে বানচাল করে শেষবারের মতো বিদেশী পশ্চিমা শোষকেরা সে কথার প্রয়োজনীয়তা হাড়ে হাড়ে প্রমাণ করেছে।
৫৪ হাজার ৫শ ৬ বর্গমাইল বিস্তৃত ভৌগোলিক এলাকার ৭ কোটি মানুষের জন্যে আবাসিক ভূমি হিসেবে স্বাধীন ও সার্বভৌম এ রাষ্ট্রের নাম ‘বাংলাদেশ’। স্বাধীন ও সার্বভৌম ‘বাংলাদেশ’ গঠনের মাধ্যমে নিম্নলিখিত তিনটি লক্ষ্য অর্জন করতে হবে।
১। স্বাধীন ও সার্বভৌম ‘বাংলাদেশ’ গঠন পৃথিবীর বুকে একটি বলিষ্ঠ বাঙ্গালী জাতি সৃষ্টি ও বাঙ্গালীর ভাষা, সাহিত্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির পূর্ণ বিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে;
২। স্বাধীন ও সার্বভৌম ‘বাংলাদেশ’ গঠন করে অঞ্চলে অঞ্চলে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বৈষম্য নিরসনকল্পে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি চালু করে কৃষক, শ্রমিক রাজ কায়েম করতে হবে।
৩।স্বাধীন ও সার্বভৌম ‘বাংলাদেশ’ গঠন করে ব্যক্তি, বাক ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতাসহ নির্ভেজাল গণতন্ত্র কায়েম করতে হবে।
বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালনার জন্যে নিম্নলিখিত কর্মপন্থা গ্রহণ করতে হবে:
(ক) বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম, মহল্লা, থানা, মহকুমা, শহর ও জেলায় স্বাধীনতা সংগ্রাম কমিটি গঠন করতে হবে;
(খ) সকল শ্রেণির জনসাধারণের সহযোগিতা কামনা ও তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে;
(গ) শ্রমিক এলাকায় শ্রমিক ও গ্রামাঞ্চলে কৃষকদের সুসংগঠিত করে গ্রামে গ্রামে, এলাকায় এলাকায় ‘মুক্তিবাহিনী’ গঠন করতে হবে
(ঘ) হিন্দু-মুসলমান ও বাঙ্গালী-অবাঙ্গালী সাম্প্রদায়িক মনোভাব পরিহার করতে হবে এবং সম্প্রীতি বজায় রাখতে হবে;
(ঙ) স্বাধীনতা সংগ্রামকে সুশৃংখলার সাথে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে পারস্পরিক যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে এবং লুটতরাজসহ সকল প্রকার সমাজবিরোধী ও হিংসাত্মক কার্যকলাপ বন্ধ করতে হবে।

স্বাধীনতা আন্দোলনের ধারা নিম্নরূপ হবে:
(অ)তথাকথিত পাকিস্তানের স্বার্থের তল্পীবাহী পশ্চিমা অবাঙ্গালী মিলিটারীকে বিদেশী ও হামলাকারী শত্রুসৈন্য হিসেবে গণ্য করতে হবে এবং এ হামলাকারী শত্রু সৈন্যকে খতম করতে হবে;
(ই) বর্তমান বিদেশী উপনিবেশবাদী শোষক সরকারকে সকল প্রকার ট্যাক্স-খাজনা দেয়া বন্ধ করতে হবে;
(ঈ) স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের ওপর আক্রমণরত যে-কোন শক্তিকে প্রতিরোধ, প্রতিহত, পাল্টা আক্রমণ ও খতম করার জন্যে সকল প্রকার সশস্ত্র প্রস্তুতি নিতে হবে।
(উ) বৈজ্ঞানিক ও গণমুখী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সকল প্রকার সংগঠন গড়ে তুলতে হবে;
(ঊ) স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি...' সঙ্গীতটি ব্যবহৃত হবে।
(ঋ) শোষক রাষ্ট্র পশ্চিম পাকিস্তানী দ্রব্য বর্জন করতে হবে এবং সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে;
(এ) উপনিবেশবাদী পাকিস্তানী পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ব্যবহার করতে হবে;
(ঐ) স্বাধীনতা সংগ্রামে রত বীর সেনানীদের সর্বপ্রকার সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদান করে বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ুন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক।
স্বাধীন ও সার্বভৌম ‘বাংলাদেশ’ গঠন আন্দোলনের এ পর্যায়ে নিম্নলিখিত জয়ধ্বনি ব্যবহৃত হবে:
* স্বাধীন সার্বভৌম ‘বাংলাদেশ'-দীর্ঘজীবী হউক
* স্বাধীন কর স্বাধীন কর-বাংলাদেশ স্বাধীন কর
* স্বাধীন বাংলার মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব
* গ্রামে গ্রামে দুর্গ গড়-মুক্তিবাহিনী গঠন কর
* বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর
* মুক্তি যদি পেতে চাও-বাঙ্গলীরা এক হও


বাংলা ও বাঙ্গলীর জয় হোক
জয় বাংলা।
স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ।

পল্টন ময়দানে ৩ মার্চ বিকেলে ছাত্রলীগ ও জাতীয় শ্রমিক লীগের যৌথ জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ দেন।
জনসভায় বঙ্গবন্ধু ৬ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিনি সকাল ৬-২টা পর্যন্ত হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ঘোষণায় বলা হয়, এ সময়ে কোর্ট-কাচারি, সরকারি অফিস, কলকারখানা, রেল, স্টীমার, বিমান ও সকল যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ থাকবে, সামরিক বাহিনী প্রত্যাহার ও জনগণের প্রতিনিধির নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর না করা পর্যন্ত ট্যাক্্রও খাজনা বন্ধ রাখার আহবান জানান। জনসমুদ্রে জনগণের তুমুল করতালির মধ্যে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, ক্ষমতা সমর্পণ করে সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত স্বাধিকারকামী বাংলার মানুষ সরকারের সঙ্গে আর সহযোগিতা করবে না। কোনো কর-খাজনাও দেবে না।
সর্বাত্মক অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়ে সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের তিনি অফিস-আদালতে যাওয়া বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। প্রচারমাধ্যমের প্রতি তিনি বাঙালির আন্দোলনের খবর প্রকাশ-প্রচারের ওপর আরোপিত বিধিনিষেধ অগ্রাহ্য করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘বাংলার মানুষ খাজনা দেয় রাষ্ট্র চালানোর জন্য, গুলি খাওয়ার জন্য নয়।’ গণহত্যার বদলে সেনাবাহিনীকে অবিলম্বে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়ার এবং বাংলার শাসনভার নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে তুলে দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘হয়তো এটিই আপনাদের সামনে আমার শেষ ভাষণ। ৭ মার্চ রেসকোর্সে আমার বক্তৃতা করার কথা। কিন্তু সে সুযোগ আমাকে না-ও দেওয়া হতে পারে। তাই আপনাদের কাছে আমি বলে যাচ্ছি, আমি যদি না-ও থাকি আন্দোলন যেন না ধমে। আমি থাকি আর না থাকি, আমার সহকর্মীরা আছেন। তাঁরাই নেতৃত্ব দেবেন। আর যদি কেউই না থাকেন, তবু আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। যেকোনো মূল্যে বাংলার স্বাধিকার ছিনিয়ে আনতে হবে। আমার সুস্পষ্ট নির্দেশ রইল, যে যেখানে থাকুন, নিষ্ঠার সঙ্গে নিজ দায়িত্ব পালন করুন।
বিশাল সেই জনসমুদ্র শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করা হয় এবং তাদের আরাধ্য কাজ সমাপ্ত করার দৃঢ় শপথ গ্রহণ করা হয়। সভায় বক্তব্য দেন প্রাক্তন ছাত্রনেতা ও ডাকসু ভিপি এবং সদ্য নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ, ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখন ও শ্রমিকনেতা আবদুল মান্নান।

৪ মার্চ, বৃহস্পতিবার: সকাল ৬টা হতে দুপুর ২টা পর্যন্ত প্রদেশব্যাপী হরতাল পালিত হয়। গত দুই দিনের হরতালে দেশের বিভিন্ন স্থানে হতাহতের ঘটনায় গায়েবানা জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। চট্টগ্রামে বাঙ্গালী-অবাঙ্গালী সংঘর্ষে ১২০ জন নিহত ও ৩৩৫ জন আহত হন। বেতার ও টেলিভিশনে হরতালের সমর্থনে জয় বাংলার বন্দনাগীতি প্রচারিত হয়। রেডিও পাকিস্তান পরিণত হয় ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্রে।’ মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সাত কোটি বাঙ্গালীর স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের দাবি জানান। পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন এক জরুরি সভায় বাংলার জনসাধারণের সার্বিক মুক্তি আদয়ে গণঅন্দোলনের সাথে একাত্নতা ঘোষণা করে। দেশজুড়ে আন্দোলনের এই জোয়ারে শিক্ষক, শিল্পী ও সাংবাদিকেরা অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়ে নানামুখী তৎপরতায় একাত্ম হয়ে পড়েন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেন, চরম ত্যাগ স্বীকার ছাড়া কোনো দিন কোনো জাতির মুক্তি আসেনি। তিনি যেকোনো মূল্যে স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য সবাইকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেন। স্বতস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করায় বঙ্গবন্ধু জনগণকে ধন্যবাদ জানিয়ে নির্দেশনা জারি করেন। নির্দেশনায় বলা হয়,“হরতাল জনিত পরিস্থিতির জন্য যেসব সরকারি-বেসরকারি অফিসে এখন পর্যন্ত মাসিক বেতন হয়নি, সেসব অফিস শুধুমাত্র বেতন দেয়ার জন্য আগামী দুদিন হরতালকালে বেলা ২.৩০ থেকে বেলা ৪.৩০ পর্যন্ত খোলা থাকবে। সর্বোচ্চ ১৫০০ টাকা পর্যন্ত বেতনের চেক ভাঙ্গাবার উদ্দেশ্যে এবং শুধু বাংলাদেশের মধ্যে লেনদেনের জন্য ব্যাংকগুলোর জন্যও এ নির্দেশনা প্রযোজ্য হবে।’ হরতালে গোটা প্রদেশের বেসামরিক শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যরা শান্তিরক্ষার জন্য শহরের রাজপথে টহল দেন। ঢাকার সঙ্গে বাইরের জল, স্থল ও বিমান যোগাযোগ বন্ধ থাকে। ঢাকায় রাজারবাগ পুলিশ লাইনস ও পিলখানার ইপিআর ব্যারাকে বাঙালি জওয়ানেরা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে রাজপথের মিছিলের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন প্রেসক্লাবে এক জরুরি সভায় মিলিত হয়ে জনগণের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে। বক্তারা বলেন, সরকার সংবাদ প্রকাশের ওপর আরোপিত বাধানিষেধ তুলে না নিলেও সাংবাদিকেরা তা মানবেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৫ জন শিক্ষক এ দিন বিবৃতি দিয়ে পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকার গণবিরোধী ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন অধ্যাপক আবু মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী, ড. আহমদ শরীফ, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, ড. খান সারওয়ার মুরশিদ প্রমুখ। আরেকটি বিবৃতি আসে ওয়াহিদুল হক, আতিকুল হক, মুস্তাফা জামান আব্বাসী, ফেরদৌসী রহমান, গোলাম মুস্তাফা, জাহিদুর রহিম, লায়লা হাসান, হামিদা আতিক, অজিত রায় প্রমুখ বেতার-টেলিভিশনের শিল্পীর কাছ থেকে। তাঁরা সেনাবাহিনীর নির্মম-নির্দয় কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়ে বেতার ও টিভির অনুষ্ঠানমালা বর্জন করার ঘোষণা দেন। ঢাকায় বেতার ও টেলিভিশনের কর্মীরা মানুষের কাছে রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রকে ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র’ এবং পাকিস্তান টেলিভিশনকে ‘ঢাকা টেলিভিশন’ হিসেবে উপস্থাপন করেন। বেতার-টেলিভিশনে ‘জয় বাংলা’ নিয়ে গান প্রচার করা হয়।

৫ মার্চ, শুক্রবার: টঙ্গী শিল্প এলাকায় সেনাবাহিনীর গুলিতে বহু শ্রমিক হতাহত হলে বিক্ষুদ্ধ শ্রমিক-জনতা টঙ্গীর কংক্রিটের ব্রীজের পাশর্^বর্তী কাঠের ব্রীজটি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় এবং বড় বড় গাছের গুড়ি ফেলে ব্যাড়িক্যাট সৃষ্টি করে রাস্তা বন্ধ করে দেয়। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে নির্যাতন বন্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যাান্য বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আহবান জানান। লে. জেনারেল টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ঢাকা পৌঁছান। ফরিদপুরে আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দ স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে। এ দিন লেখক, বুদ্ধিজীবি ও পূর্ববাংলার সরকারি কলেজের শিক্ষক সমিতি বঙ্গবন্ধুর আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানায়। আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ এক বিবৃতিতে বলেন, নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ছাড়া আর কিছুই নয়। তিনি অবিলম্বে নরহত্যা বন্ধের আহবান জানান। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ এদিন এক বিবৃতিতে বলেন, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর, সিলেটসহ বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানে মিলিটারির বুলেটে নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষ, শ্রমিক, কৃষক ও ছাত্রদের হত্যা করা হচ্ছে। অবিলম্বে এই নরহত্যা বন্ধ করতে হবে। যারা এ ঘটনার জন্য দায়ী, তাদের জানা উচিত যে নির্বিচার নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষকে এভাবে হত্যা করা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ছাড়া আর কিছুই নয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষের ওপর আজ যে নির্যাতন নেমে এসেছে, তাঁরা বীরের মতো তা প্রতিরোধ করছেন। আজ আবালবৃদ্ধবনিতা-নির্বিশেষে প্রত্যেক মানুষ মুক্তি অর্জন এবং এক স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

৬ মার্চ, শনিবার: ঢাকাসহ সারা দেশে সর্বাত্নক হরতাল পালিত। মহিলা আওয়ামীলীগের উদ্যোগে বিরাট মহিলা শোভযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। এক বেতার ভাষণে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবানের ঘোষণা দেন। ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণের পরপরই বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও পূর্ব পাকিস্তান শাখার ওয়ার্কিং কমিটির জরুরি যৌথ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের বলেন, শহীদদের রক্ত মাড়িয়ে তিনি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনায় যেতে পারেন না। এই দিনটিতেও ঢাকাসহ সারা বাংলায় সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে ঢাকা টানা পঞ্চম দিনের মতো গর্জে ওঠে। সারা বাংলা ছিল সভা-সমাবেশ ও মিছিলে উত্তাল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সকাল থেকে সর্বস্তরের মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কাজে যোগদান থেকে বিরত থাকেন। শান্তিপূর্ণ হরতাল পালন শেষে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বেলা আড়াইটা থেকে বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত ব্যাংক এবং যেসব বেসরকারি অফিসের কর্মচারী বেতন পাননি, সেসব অফিস বেতন দেওয়ার জন্য খোলা থাকে। আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ এক বিবৃতিতে বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষকে মৌলিক অধিকার হইতে বঞ্চিত করা এবং বাংলাদেশকে পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমী স্বার্থবাদী মহলের ঔপনিবেশ ও বাজার হিসেবে শোষণের গূঢ় রাজনৈতিক মতলবে বেসামরিক অধিবাসীদের ভয়-ভিিত দেখানোর জন্য সামরিক বাহিনীর অস্ত্র ব্যবহার করা হইতেছে। ছাত্রলীগ ও ডাকসু নেতৃবৃন্দ এক বিবৃতিতে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দান থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রেডিওতে সরাসরি সম্প্রচারের দাবি জানান। (চলবে)


বিভাগ : মতামত


এই বিভাগের আরও