ভাস্কর অলি মাহমুদের ভাস্কর্য: উত্থিত আঙ্গুলের আগুন

১৬ নভেম্বর ২০২০, ০৮:৪১ পিএম | আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:৪৬ এএম


ভাস্কর অলি মাহমুদের ভাস্কর্য: উত্থিত আঙ্গুলের আগুন
 
       -------------------------------মহসিন খোন্দকার--------------------------
                             
 
উত্থিত এই আঙ্গুল কি ইঙ্গিত করে অনিরুদ্ধ আকাশের আগুন,যা পুড়ে ছারখার করে দিবে অত্যাচারীর অযুত-নিযুত অনাচার? নাকি একটি জাতিকে দেখাচ্ছে অনন্য উচ্চতার অক্লীব অনুসূর্য,যেখানে নেই কোনো প্রভেদ-বিভেদ, দ্বেষ-বিদ্বেষ? নাকি এই তর্জনী যুগ-যুগান্তরের অবর্ণনীয়,অব্যক্ত নিপীড়নের টেনে ধরবে আল-জিভ? নাকি এই শুধু আকাশছোঁয়া এক অনন্য শেখ মুজিব?
 
মগজে অনেক প্রশ্ন থাকলেও উত্তর একটাই।এই আঙ্গুল প্রতিবাদী ঝড় তোলে গণসমুদ্রে।এই আঙ্গুল আগুন ধরায় ঝড়ের হাওয়ায়।এই আঙ্গুল শোষকের বিরুদ্ধে স্পর্ধিত ভঙ্গিমা।এই আঙ্গুল দেখায় মুক্তির নয়া দিগন্ত--আরেক অভিষ্ট আলোর প্রান্ত!
 
এই তর্জনী শুধু একাত্তরের উত্তাল দিনে ৭ মার্চ একটি নির্দিষ্ট দিনে, একটি নির্দিষ্ট ক্ষণে, একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তে রাজনৈতিক তান্ত্রিকের তরঙ্গায়িত তর্জনী নয়।এটি তেইশ বছরের লাঞ্ছনা বঞ্চনার বিরুদ্ধে স্পর্ধিত সাহসী হুশিয়ারি, এই তর্জনী সময়ের বিক্ষুব্ধ বেয়োনেট, যা দু:সময় ভেদ করে ওঠে যাবে সুসময়ের সুউচ্চ চূড়ায়। এই তর্জনী তান্ত্রিকের রাজকীয় রাইফেল--হত্যা করতে দারুণ প্রস্তুত প্রদুষ্ট প্রেত পশুদের।
 
একাত্তরের উত্তাল দিনের সেই স্পর্ধিত তরঙ্গায়িত তর্জনীকে তরুণ ভাস্কর অলি মাহমুদ স্হির রূপ দিয়েছেন নরসিংদীর ললাটে (ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সাহেপ্রতাপ মোড়ে)। উদ্দেশ্য আগুনঝরা সেই উত্তাল দিনের ইতিহাসকে বিস্তৃত করা,গণমানুষের সামনে জ্বলন্ত ইতিহাসকে শিল্প-সংস্কৃতির রূপে তোলে ধরা। অনেকটা অদ্ভুত আঁধারে ঢেকে থাকা আমাদের গর্বিত ইতিহাসকে গণমানুষের সামনে নান্দনিক ভঙ্গিমায় উপস্হাপন করা--সেই সাথে মানুষের সাথে ইতিহাস-ঐতিহ্য ও শিল্পের সেতুবন্ধন ঘটানো।
 
প্রাচীন গুহাচিত্র, ছাপচিত্র, খুঁদাইশিল্প, ভাস্কর্য, শিলালিপি, ছাপাঙ্কিত মৃদ্রা ইত্যাদি ছিল বলেই আমাদের ইতিহাস চর্চা সহজ হয়েছে।এসবের ওপর চোখ রেখেই আমরা মানুষের সভ্যতার ক্রমবিকাশ,প্রবাহমান জীবনাচার ও মানুষের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাই।আমরা কেমন ছিলাম বা মানুষের জীবন কেমন ছিল এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই এসব শিল্প-সংস্কৃতির আশ্রয় নিতে হবে।লিখন পদ্ধতি আবিস্কারের অনেক আগে থেকেই প্রাচীন গুহাচিত্র ও ভাস্কর্য শিল্পের উদ্ভব হয়েছে যা আমাদের অতীত জীবনাচারের অকাট্য দলিল।
 
তাই ভাস্কর্য ইতিহাসের অংশ।বলা যায় ইতিহাসের স্হিরচিত্র।প্রাচীন মেসোপটেমীয় সভ্যতার যুগ(অসেরীয়,সুমেরীয় ও ব্যবিলনীয় সভ্যতা) থেকে শুরু করে মিশরীয় সভ্যতা এমনকী রোমান সভ্যতায়ও আমরা ভাস্কর্য শিল্পের উৎকর্ষতা দেখতে পাই।মুসলিম দেশ যেমন মিশর, সিরিয়া, ইরাক, ইরান এসব দেশেও অনেক নান্দনিক ভাস্কর্য রয়েছে যা সেসব দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও নিজস্ব শিল্প-সংস্কৃতির পরিচয় বাহক। কিন্তু আমাদের দেশে ভাস্কর্য বা শিল্প-সংস্কৃতির বিরুদ্ধ বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে দীর্ঘদিন যাবত।বিগত দিনে, বিশেষ করে হেফাজতের আন্দোলনের সময় ও ২০০১ সালে ১ অক্টোবর নির্বাচনের পর এ দেশের অনেক ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। এই দেশে ভাস্কর্যকে খুব সহজে মূর্তি বানিয়ে ফেলা যায় এবং আরো দ্রুত ফতোয়া জারি করে ধর্মীয় তরবারি দিয়ে তা খুব সহজে গুড়িয়ে দেওয়া যায়।যেমন  বিগতদিনে রাজধানীর মতিঝিলের বকভাস্কর্যে আঘাত হানা হয়েছে, ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবেশদ্বারের ভাস্কর্যে আঘাত হানা হয়েছে,মৌলবাদীদের চাপের মুখে হাইকোর্টের সামনে থেকে এক ভাস্কর্য সরানো হয়েছে, ময়মনসিংহের শশীলজের সামনে অবস্হিত ভেনাসের ভাস্কর্যটি সরানো জন্যে একটি চক্র ক্রমাগত চাপ দিয়ে যাচ্ছে। অতি সম্প্রতি ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন এ দেশ থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলার হুমকি দিয়েছে দুর্বিনীত ভঙ্গিমায়।
 
ভাস্কর অলি মাহমুদ এ সময়ের একজন সাহসী সত্তার নাম।জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবর্ষে নরসিংদীর ললাটে এমন শিল্প সুষমা এঁকে দিয়ে আমাদের শহরকে শুধু নান্দনিকই করেননি, করেছেন গৌরবোজ্জ্বল।এই গৌরব ও অহংকারের আরেক দাবীদার নরসিংদী পৌরসভার জনবান্ধব জননন্দিত মেয়র কামরুজ্জামান কামরুল যিনি শুধু অর্থ দিয়েই সহযোগিতা করেননি এই ভাস্কর্য নিমার্ণে সঠিক সময়ে দিয়েছেন মূল্যবান দিক নির্দেশনা ও পরামর্শ। এই দু'জনের বদান্যতায় আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যমন্ডিত নরসিংদীর ললাটে অমর হয়ে থাকুক এই তর্জনী ভাস্কর্য, মহান ব্যক্তিকে নিয়ে এই মহানকীর্তি। কী কারণে যেনো জাতিরজনক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এ বছর প্রকাশিত আমার ছড়াগ্রন্থটিও ভাস্কর অলি মাহমুদের তর্জনী ভাস্কর্যের সাথে মিলে যাচ্ছে।আমার ছড়াগ্রন্থের নাম "আকাশছোঁয়া শেখ মুজিব", কারণ বোধ হয় একটাই আমরা দু'জন  চিন্তা-চেতনার একই চাতালে হাঁটাহাঁটি করছি। জয়তু অলি মাহমুদ। জয়তু জননন্দিত নরসিংদীর পৌরমেয়র কামরুজ্জামান।
 
 মহসিন খোন্দকার
  কবি ও লেখক
 সাধারণ সম্পাদক, প্রগতি লেখক সংঘ, নরসিংদী জেলা সংসদ।

বিভাগ : মতামত


এই বিভাগের আরও