বাল্যবিবাহ রোধে সামাজিক সচেতনতার বিকল্প নেই 

২৪ জানুয়ারি ২০১৯, ১১:২৭ এএম | আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১২:১৮ পিএম


বাল্যবিবাহ রোধে সামাজিক সচেতনতার বিকল্প নেই 

মাহবুবুর রহমান

" বাল্য বিবাহ " শব্দটা বাংলাদেশে একটা সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। এই ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে কত প্রাণ অকালে ঝড়ে পড়ছে তার সঠিক হিসেব কি কেউ রাখছে বা নিচ্ছে? বলা হয় অপুষ্টি বা জরায়ু ক্যান্সার বা কঠিন কোন অসুখে পড়ে মারা গেছে। অশিক্ষিত পরিবারে কন্যা সন্তান জন্ম নেয়াটাই যেন পাপ। পিতামাতা শুধু একথাটাই ভাবেন, মেয়েটা কখন একটু বড় হবে? বিয়েটা দিতে পারলেই যেন বাঁচেন। একটি অসুস্থ প্রতিযোগীতার মতো চলছে ব্যাপারটি। সরকারীভাবে বহু সচেতনতা ও শাস্তির বিধান থাকলেও কে শুনে কার কথা।  সবচেয়ে বড় প্রয়োজন নিজে সচেতন হওয়া, আর সেটাইতো হচ্ছে না। আইনের চোখ ফাঁকি দিতে বয়স বাড়িয়ে কোর্ট হতে এফিডেবিট করিয়ে নেন নয়তো কাবিনটাই বাদ দেন। অতীতের বাল্য বিবাহের সামাজিক কুপ্রথা আজও চলছে। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও তা বন্ধ করা যায়নি। সকলের চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করে কেন যায়নি? কারা এ জন্য দায়ী? সরকার, সমাজ না ব্যক্তি মানুষ?

জাতিসংঘের শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) কর্তৃক প্রকাশিত ২০১৪ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৮ বছরের আগে ৬৬ শতাংশ মেয়ে এবং একই বয়সের ৫ শতাংশ ছেলের বিয়ে হচ্ছে। আগামী প্রজন্মের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠা এবং সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতেও বাল্যবিবাহকে অন্যতম বাধা মনে করা হচ্ছে।

সুন্দর ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী বাল্যবিয়ের শিকার এক মহিলার বক্তব্য-  ফাইভে নাকি ফোরে পড়ার সময় বিয়ে হয়েছিল আমার। জামাই বিদেশী দেইখা তাড়াতাড়ি বিয়া দিয়া দিছে বাপ-মায়৷ বাচ্চাকাচ্চা কয় জন? জিজ্ঞাসা করতে সে উত্তর দিল, তারা পাঁচ ভাই বোন; বড় মাইয়াডারে বিয়া দিছি, মাইয়াডার ঘরে নাতিনও হইছে৷ নাতিনডার সইলডাও ভালা না৷ আমার জি-পুতগুলো সবগুলোই আমার মতন দূর্বল, নাতিনডাও দূর্বলই হইছে; রুহডা যেমন আইয়ে- যায়৷ তোমার স্বামী কেমন আছে জিজ্ঞাসা করতেই সে আবার উত্তর দিলো, দেহের স্বাস্থ্যটাস্থ্য ভালাই, হের কোনো রোগ-টোগ নাই। ভাবলাম নানীর অবস্থাই যা আর  মায়ের অবস্থা কী আর ঐ শিশু নাতীটির-ই বা কি অবস্থা? এ শিশুর ভবিষ্যত-ই বা কী?

বাল্যবিবাহ আমাদের দেশে দারিদ্রের দুষ্ট চক্রের মতোই৷ সাধারণত গ্রামাঞ্চলে সুন্দরি মেয়েরাই এর কবলে পড়ে বাল্যবিবাহের স্বীকার হয়৷ যে মেয়ের কম বয়সে বিয়ে হয়, সে মেয়ে তার পরবর্তি প্রজন্মগুলোও কম বয়সে বিয়ে দিয়ে থাকে৷ এতে তারা তাদের সমাজে একটা গৌরববোধ করাসহ আনন্দবোধও করে৷ তাড়াতাড়ি মেয়ে বিয়ে দিতে পারলেই যেন ইজ্জত রক্ষা পেল! প্রতিবেশীর কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতাটাও যেন বেড়ে গেল! গ্রামাঞ্চলের সুন্দরি মেয়েরাই বেশিরভাগ বাল্যবিবাহের কবলে পড়ে৷ অনেক সময় সে সুন্দরি মেয়েদের কন্যা সন্তানগুলোও সুন্দরি হওয়ায় তারাও তাদের মেয়েগুলোকে বাল্যবিবাহ দিয়ে থাকে৷ এ ঐতিহ্য মূর্খ পরিবারগুলোতেই বেশি দেখা যায়৷ অশিক্ষিত যৌথ পরিবারগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে- অনেক পরিবারের চার-পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে বড় ভাই ব্যতীত সকলেই বিদেশ থাকে৷ বড় ভাইয়ের মেয়ে থাকলে সে চায় যৌথ পরিবার থাকতেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজ মেয়েটা তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে কন্যাদায় থেকে মুক্তি পেতে৷ ভবিষ্যতে সাংসারিক অভাব অনটনে পড়ার ভঁয়ে এক সাথে থাকতেই নিজ মেয়েটি বাল্যবিবাহ দিয়ে থাকে৷ তা দেখে তাদের ছোট ভাইয়েরাও এ রীতি অনুসরণ করে থাকে৷ এতে করেই বাল্যবিবাহের হার পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পেয়ে থাকে৷

বাল্যবিবাহ একটি জাতিকে রুগ্ন করে দেয়৷ করে দেয় মেধাশূণ্য। মেয়েটি শুধু নিজেই শারীরিক ঝুঁকিতে পড়ে না তার পরবর্তি প্রজন্মগুলোকেও ঝুঁকিতে ফেলে৷ অনেক সময় আবেগ ও কল্পণার বশবর্তী হয়েও অভিভাবক মেয়েকে বাল্য বয়সে বিয়ে দিয়ে থাকে৷ তাড়াতাড়ি বিয়ে দিলে তাড়াতাড়ি বেয়াই-বেয়াইন নিয়ে আনন্দ ও নানি হয়ে নতুন নাতি-নাতনির সাথে সময় কাটাবে সে কল্পণাতেও কিছু মানুষ কিশোরীদেরকে শারীরিক ঝুঁকিতে ধাবিত করে থাকে৷

বাল্য বিবাহ নামক এই দুরারোগ্য ব্যাধিটি সারাতে সামাজিক সচেতনতা সমাজের প্রতিটি স্তরে সচেতনতা সৃষ্টি করে অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখাতে পারে৷ সচেতন সমাজ সৃষ্টি করতে পারে আলোকিত মানুষ ও তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত৷ তাই বাল্যবিবাহ রোধে সমাজের প্রতিটি স্তরে সচেনতা সৃষ্টি করে বাল্যবিবাহের সর্বনাশা পথ থেকে মেয়েদের মুক্তি করে কিশোরীদের আলোর পথ দেখাতে সমাজের প্রতিটি মানুষ অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করতে হবে৷

পরিশেষে আমি বলতে চাই, এই যে বাল্যবিবাহ এটা শুধু আমানুষিকতাই নয়, এটা হিংস্রতা, সতীদাহ প্রথার ভিন্নরূপ। তাহলে এর প্রতিষেধক কী? সমাধানই বা কী? আমার মনে হয়, গ্রামে-গঞ্জে মেয়েদের বাধ্যতামূলক অবৈতনিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রসার ঘটানো, যাতে তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়ে, সচেতনতা বাড়ে আর প্রতিবাদী ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে। পাশাপাশি এর প্রতিরোধে স্থানীয় প্রশাসন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে এবং বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন' এর সফল বাস্তবায়ন করতে হবে। এসব কাজ বাস্তবায়ন করলেই বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ সম্ভব। কিন্তু এসব কাজের সফল বাস্তবায়ন কি হবে কোনদিন? হয়তোবা হবে। সেই দিনটির অপেক্ষায় রইলাম

 


বিভাগ : মতামত


এই বিভাগের আরও