ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলে পিতাপুত্রসহ নিহত ৫, আহত শতাধিক, বিভিন্ন ভবনে ফাটল

২১ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:০৩ পিএম | আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:১৪ পিএম


ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলে পিতাপুত্রসহ নিহত ৫, আহত শতাধিক, বিভিন্ন ভবনে ফাটল

নিজস্ব প্রতিবেদক:

নরসিংদীতে ভয়াবহ ভূমিকম্পে দেয়াল চাপায় আহত হয়ে পিতাপুত্রসহ ৫ জন নিহত হয়েছেনে। এসময় আহত হয়েছেন বিভিন্ন বয়সী শতাধিক মানুষ। তারা পলাশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, সদর হাসপাতাল ও জেলা বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। নরসিংদীর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসাইন এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।  

নিহতরা হলেন- সদর উপজেলার চিনিশপুর ইউনিয়নের গাবতলি এলাকার দেলোয়ার হোসেন উজ্জ্বল (৩৭) ও তাঁর ছেলে হাফেজ মো. ওমর (৮)। পলাশ উপজেলার মালিতা পশ্চিমপাড়া গ্রামের কাজেম আলী ভূইয়া (৭৫) ও কাজীরচর নয়াপাড়া গ্রামের মৃত সিরাজ উদ্দিনের ছেলে নাসির উদ্দিন (৬৫) এবং শিবপুরের জয়নগর ইউনিয়নের আজকীতলা গ্রামের ফোরকান মিয়া (৪৫)।  

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, সকাল ১০ টা ৩৮ মিনিটে নরসিংদী সদর ও পলাশ উপজেলার মধ্যবর্তী অঞ্চলে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়। এই ভূমিকম্পে নরসিংদী জেলাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভূমিকম্পন অনুভূত হয়।

বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৭। এতে নরসিংদীসহ বিভিন্ন জায়গায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে। পলাশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক ভবনসহ বিভিন্ন ভবনে হালকা ফাটল দেখা দেয়।  ভূমিকম্পের সময় অনেকেই আতঙ্কে ঘর থেকে রাস্তায় বেরিয়ে আসার সময় পড়ে গিয়ে আহত হয়।

 

যেভাবে মারা গেলেন ৫ জন:

সদর উপজেলার চিনিশপুর ইউনিয়নের গাবতলি এলাকায় নির্মাণাধীন ভবনের দেয়াল থেকে ইট ধসে পাশের বসতবাড়ির ছাদের ওপর আছড়ে পড়ে। মুহূর্তেই বাড়ির সানশেড ভেঙ্গে হফেজ মো. ওমর (০৮), তার বাবা দেলোয়ার হোসেন ও দুই বোন আহত হয়। তাদেরকে প্রথমে নরসিংদী সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। পরে আশংকাজনক অবস্থায় বাবা ও ছেলেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়। সেখানে নিয়ে গেলে ছেলে মো. ওমরকে মৃত ঘোষণা করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। পরে আশংকাজনক অবস্থায় চিকিৎসাধীন থাকা বাবা দেলোয়ার হোসেনও মারা যান।

 

হাসপাতালে থাকা ওমরের চাচা জাকির হোসেন বলেন, ভূমিকম্পের সময় দোলোয়ার তার ওমর ও দুই মেয়েকে নিয়ে বাইরে যাচ্ছিলেন। এসময় বাড়ির সানশেড ভেঙ্গে তাদের ওপর পড়ে। পরে সবাই মিলে তাদেরকে আহত অবস্থায় হাসপাতাল নিয়ে গেলে দেলোয়ার ও ওমরকে ঢাকা মেডিকেলে রেফার্ড করে। 

 

এদিকে পলাশ উপজেলার মালিতা পশ্চিমপাড়া গ্রামের কাজেম আলী ভূইয়া (৭৫) মাটির ঘরের দেয়ালের নিচে চাপা পড়েন। সেখান থেকে তাকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে প্রথমে পলাশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পরে নরসিংদী ১০০ শয্যা বিশিষ্ট জেলা হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান বলে- জানান উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) আব্দুল্লাহ আল মামুন। এছাড়া কাজীরচর নয়াপাড়া গ্রামের মৃত সিরাজ উদ্দিনের ছেলে নাসির উদ্দিন (৬৫) ভূমিকম্পের সময় আতংকে স্ট্রোক করে মারা গেছেন বলে জানান জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসাইন। অপরদিকে শিবপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো: আফজাল হোসাইন জানান, ভূমিকম্পের সময় গাছ থেকে পড়ে আহত হলে উপজেলা হাসপাতালে আনার পর মারা গেছেন শিবপুর উপজেলার ইউনিয়নের আজকীতলা পূর্বপাড়া গ্রামের শরাফত আলীর ছেলে ফোরকান মিয়া (৪৫)।

 

 

ঘোড়াশাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে আগুন:

ভূমিকম্পে ঘোড়াশাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সাবস্টেশনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ পুড়ে যায়। যার কারণে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে পড়ে।

পলাশ ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মো. আব্দুল শহিদ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, খবর পেয়ে পলাশ ফায়ার সার্ভিসের ২টি ইউনিটের চেষ্টায় অল্প সময়ের মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয়।

ঘোড়াশাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রধান প্রকৌশলী মো. এনামুল হক জানান, ভূমিকম্পে এ আগুনের ঘটনা ঘটে। বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক করতে কাজ চলছে।

 

বিভিন্ন ভবনে ফাটল:

পলাশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ৪টি আবাসিক ভবনে কিছুটা ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া পলাশ উপজেলার ঘোড়াশাল বাজারের ছয়তলা বিল্ডিং এসএ প্লাজায় ফাটল দেখা দেয়। বিল্ডিং এ মারকাযুস্ সুন্নাহ তাহ্ফীজুল কুরআন মাদ্রাসা রয়েছে। মাদরাসার পরিচালক মুফতী সালাহ উদ্দীন আনসারী ফাটলের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

এছাড়া ঘোড়াশালের লেবুপাড়া এলাকায় ঘোড়াশাল ডেইরী ফার্মের মাঠের মাটি ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। এছাড়া পলাশ রেসিডেনসিয়াল স্কুলের পাশে একটি বিল্ডিং এ ফাটল দিয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা। ঘোড়াশাল নতুন বাজার গ্রামের ইসহাক মিয়ার বাড়ি ভেঙে পড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া প্রাচ্যের ম্যানচেষ্টার খ্যাত পাইকারী কাপরের হাট নরসিংদীর শেখেরচর বাবুরহাট বাজারের ধুমকেতু মাঠে একটি চারতলা ভবন সামান্য হেলে গেছে।

শহরের গাবতলী এলাকার একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা আরাফাত শাহ বলেন, ভূমিকম্পে আমার চারতলা বিল্ডিং এর বিভিন্ন দেয়ালের টাইলস ভেঙ্গে পড়ে। এতে বিভিন্ন আসবাবপত্র ভেঙ্গে গেছে। তবে বাসার সবাই সুস্থ আছি, কিন্তু আতংকে রয়েছি। বিশেষ করে বাচ্চারা অনেক ভয় পেয়েছে।

 

হাসপাতালের চিত্র:

ভূমিকম্পে শহরের বিভিন্ন এলাকায় মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এসময় বিভিন্ন ভবন, বসতবাড়ি, মার্কেট ও দোকানপাট থেকে তাড়াহুড়ো করে বের হতে গিয়ে অনেকে আহত হয়েছেন। এছাড়া ভূমিকম্পের সময় অনেকে মাথা ঘুরপাক খেয়ে পড়ে গিয়ে, বুকে ব্যাথা নিয়ে ও স্ট্রোক করে আহত হয়েছেন।

 

এসব ঘটনায় আহতদের মধ্যে নরসিংদী সদর হাসপাতালে ৫৩ জন চিকিৎসা নিয়েছেন এবং ১০০ শয্যা বিশিষ্ট জেলা হাসপাতালে ১০ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। এছাড়া পলাশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ বিভিন্ন হাসপাতালে অর্ধশত চিকিৎসা নিয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন সিভিল সার্জন সৈয়দ আমীরুল হক শামীম। এছাড়া বিভিন্ন হাসপাতালে প্রায় অর্ধশত প্রাথমিক চিকিৎসা নেন বলে জানান স্থানীয়রা।

 

নরসিংদীর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসাইন বলেন, ভূমিকম্পের প্রভাবে সদর, পলাশ ও শিবপুরে পিতাপুত্রসহ মোট ৫ জন নিহত হয়েছেন বলে নিশ্চিত হয়েছি। শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। জেলা প্রশাসনের পক্ষ হতে কন্ট্রোলরুম খোলা হয়েছে। বিভিন্ন টিমের মাধ্যমে সমন্বয় করে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। সরকারের নির্দেশনামতে পরবর্তীতে সবধরনের সহায়তা করা হবে।  

 



এই বিভাগের আরও