শিবপুরে টিলা কেটে ধ্বংস করা হচ্ছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি

০৩ জুন ২০১৯, ১১:৩১ এএম | আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:০৭ এএম


শিবপুরে টিলা কেটে ধ্বংস করা হচ্ছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

নরসিংদীর শিবপুরের বাঘাব ইউনিয়নের টেকপাড়ায় রাতের আধারে দুটি ব্যক্তিগত টিলা কাটা হচ্ছে। এসব টিলার লালমাটি বিক্রি করা হচ্ছে বিভিন্ন সিরামিক কারখানায়। গত ৫ মাস ধরে এসব চলতে থাকলেও প্রশাসন ও পুলিশ তা দেখেও দেখছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।

বাঘাব ইউনিয়নে টিলা আছে প্রায় ২৫০টি। শিবপুর উপজেলায় এসব টিলার সংখ্যা হাজারের ওপর। বাঘাব, জয়নগর, চক্রধা ও যশোর এই চারটি ইউনিয়নে ছোট-বড় এসব টিলার অবস্থান। এগুলোর অধিকাংশের উচ্চতা ২৫-৩৫ ফুটের মধ্যে। গত একবছরে বাঘাব ইউনিয়নেই কাটা হয়েছে পাঁচটি টিলা।

স্থানীয়রা বলছেন, ভ্যাকু মেশিনের সাহায্যে সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত রাতের আধারে এসব টিলা কাটা হচ্ছে। বিভিন্ন সিরামিক কারখানার পাশাপাশি কিছু মাটি ব্যবহার করা হচ্ছে নিচু এলাকা ভরাটের কাজে। মাঝে মধ্যে পুলিশ আসে, টাকা নিয়ে ফিরে যায়। প্রশাসনের লোকজনও এসব দেখেও দেখে না। প্রতিরাতেই কমপক্ষে ১০টি ট্রাক ভরে এসব লালমাটি নেওয়া হয়। যেভাবে টিলা কাটা শুরু হয়েছে তাতে আগামী ৫-১০ বছরের মধ্যে সব শিবপুরের প্রকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সব টিলাই কাটা হয়ে যাবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টিলাগুলোর লালমাটি সিরামিক কারখানাগুলোতে ওয়াল টাইলস তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। কাঁচা টাকার লোভে পড়ে স্থানীয়রা নিজেদের ব্যক্তি মালিকানাধীন টিলা কাটতে শুরু করেছেন। একটা টিলায় হাজার হাজার ট্রাক লালমাটি পাওয়া যায়। ভ্যাকু ও ট্রাকভাড়া বাদে ট্রাকপ্রতি লালমাটি বিক্রি হয় ৭০০-৮০০ টাকায়, আর ড্রাম ট্রাকপ্রতি ৩৫০০টাকা। টিলার মালিক পান ট্রাকপ্রতি ১০০ টাকা আর ড্রামট্রাকপ্রতি ৫০০ টাকা। প্রতিটি ড্রামট্রাকে ৩০-৩৫ টন মাটি ধরে। একটি টিলা কাটা হলে পাশেরটিও ধসে পড়ার ঝুঁকিতে থাকে। তখন ঝুঁকি এড়াতে সেটিও কেটে ফেলতে আগ্রহী হয়ে উঠেন টিলার মালিকেরা।

সরেজমিনে দেখা গেছে, শিবপুর-বাঘাব আঞ্চলিক সড়কের টেকপাড়ায় সড়কের গাঁ ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে গতবছরের কাটা একটি টিলার অর্ধেকটা অংশ। গা ঘেষা গলি ধরে ৫০ ফুট এগিয়ে গেলে মোল্লা পরিবারের প্রায় ৩০ ফুট উচ্চতার ব্যক্তিগত টিলা যার দুই-তৃতীয়াংশ এরই মধ্যে কাটা হয়েছে। টিলাটির মালিক খোকন মোল্লা নামের একজন। আর ভ্যাকু মেশিনে লালমাটি কেটে তা বিক্রির দায়িত্ব পালন করছেন উপজেলার মাছিমপুর ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রেজাউল কবির রনি। খোকন মোল্লার বাড়িতে দুইদফা গিয়েও তাকে পাওয়া যায় নি।

এই টিলা কাটার সাইটের দেখাশোনা করেন এমন একজন না প্রকাশ না করার শর্তে জানান, দুইমাস আগে থেকে এই টিলার লালমাটি কাটা শুরু হয়েছে। তবে কয়েকদিন ধরে বৃষ্টির কারণে বন্ধ আছে। ভ্যাকু ও ট্রাকের লোক বাদে আমরা দুজন এখানে দৈনিক ৩৫০ টাকা হাজিরায় কাজ করি।

কোথায় যাচ্ছে এই মাটি জানতে চাইলে সুমন নামের এক ড্রামট্রাক ড্রাইভার বলেন, তারাব এলাকার সুলতানা কামাল ব্রিজের আগে চায়না বাংলা সিরামিকে যাবে এই মাটি।

জানতে চাইলে রেজাউল কবির রনি জানান, টিলার মাটি কেটে বিক্রির ব্যবসা আমি করছি না, করেছে কাদির মিয়া নামের আমার এক পরিচিত জন। তার ডাকেই দুই-একবার ওই সাইটে গিয়েছিলাম। যে কাজে গুটিকয়েক লোকের বেনিফিট হয় কিন্তু সার্বিকভাবে দেশের ক্ষতি হয় এমন কাজে আমি নাই।

সরু এই গলির লালমাটির সড়কে ট্রাকের চাকার দাগ ধরে আরও ১০০ গজ এগিয়ে গিয়ে বিস্মিত হন এই প্রতিবেদক। প্রায় ১৫ বিঘা আয়তন ও ২৫-৩০ ফুট উচ্চতার একটি টিলার ৭০ শতাংশ কেটে ফেলা হয়েছে। এর মালিক নওয়াব আলী ভূইয়ার মৃত্যুর পর তার বংশধরেরা উচুঁ জায়গায় থাকতে চান না তাই টিলাটি কেটে ফেলা হচ্ছে। টিলার যে অংশ এখনো কাটা হয়নি তাতে বর্তমানে ১৭টি ঘর আছে। এছাড়াও আছে দুইটি মুরগির খামার। টিলার ওপরেই পল্লী বিদ্যুতের খুঁটি ছিল বলে এর নিচের অংশটুকু কাটা হয়নি। ৪/৫ মাস ধরে কাটা হচ্ছে এই টিলা।

টিলার ওপরে বসবাস করা মোক্তার ভূইয়া জানান, টেকের (টিলা) মধ্যে থাকা খুবই কষ্টের। বৃষ্টির দিনে লালমাটির কাদায় হাঁটা যায় না, জমির ধান উঠাতে কষ্ট হয় আবার সহজে পানিও উঠে না। তাই পুরা টিলাটি কেটে সমান করে সমান জায়গায় বাড়ি-ঘর করবো আমরা।

এ ব্যাপারে নরসিংদীর পরিবেশ আন্দোলনের সভাপতি মঈনুল ইসলাম বলেন, প্রাকৃতিকভাবে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখে যে পাহাড়-টিলা, সেগুলো ধংস করে আমরাই পরিবেশের বিপর্যয় ডেকে আনছি। যখনই গণমাধ্যমে এসব নিয়ে আলোচনা হয় তখনই প্রশাসনের একটু নড়াচড়া দেখি। কিন্তু চিরতরে এসব বন্ধের দৃশ্যমান কোন উদ্যোগ দেখা যায় না।

স্থানীয় অন্তত ৩০ জনের সাথে কথা বলেন এই প্রতিবেদক। তারা আক্ষেপ করে জানান, এক কানি ক্ষেতে বেগুন লাগালে প্রায় ৫ লাখ টাকা আয় হয় আর এদিকে পাহাড়ে কোন ফসল হয় না। লটকনের জন্য প্রসিদ্ধ এই শিবপুরে গাছপ্রতি ৫-১০ মন লটকন হয়। প্রতি মন লটকন ৩-৪ হাজার টাকায় বিক্রি করা যায়। পাহাড়ে লটকনও হয় না। তবে পাহাড়ে বাঁশঝাঁড় ও বিভিন্ন রকমের কাঠ গাছ এবং কাঁঠাল, আম ও লিচুর ফলন খুব ভালো হয়। এসব কারণে স্থানীয়দের মধ্যে টিলার প্রতি আগ্রহ কম।

একটি সূত্র বলছে, টিলাগুলোর এসব লালমাটির অধিকাংশই বিক্রি করা হয় চায়না বাংলা সিরামিক, আরএকে সিরামিকস, গ্রেটওয়াল সিরামিকস, মীর সিরামিকস, ঢাকা-সাংহাই সিরামিক ও সিলেটের হার্ডল্যান্ড সিরামিকসহ বিভিন্ন সিরামিক কারখানায়। তবে এর সিংহভাগ বিক্রি হয় চায়না বাংলা সিরামিকে।

প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সিরাজুল ইসলাম মোল্লা শিবপুরের সদ্য সাবেক সাংসদ। জানতে চাইলে সিরাজুল ইসলাম মোল্লা জানান, শুনেছি মসজিদ করার জন্য টিলাটির মালিক সেটি কাটছেন। আমি তো শুধু মাটিটা কিনছি। আমি না কিনলেও তো অন্য কেউ কিনবেই। তবে আমার সিরামিক কারখানায় ব্যবহৃত লালমাটি মালয়শিয়া থেকে কিনে আনা হয়।

নরসিংদীর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মুহাম্মদ হাফিজুর রহমান জানান, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন কাজে পাহাড়-টিলা কাটার কোন সুযোগ নেই। এটি অবশ্যই দণ্ডনীয় অপরাধ। পাহাড়-টিলা কর্তনকারীদের পাশাপাশি যারা এসব মাটি কিনছেন তাদেরও চিহ্নিত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

শিবপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোল্লা আজিজুর রহমান বলেন, বড় বড় ট্রাক দিয়ে মাটি নেওয়ায় রাস্তার ক্ষতি হচ্ছে। আমরা নিষেধ করে দিয়েছি। তবে টিলা কাটা সম্পর্কে স্থানীয় কেউ আমাদের কাছে কোন অভিযোগ করে নি।

শিবপুর নির্বাহী অফিসার হুমায়ুন কবীর জানান, অধিকাংশ টিলা ব্যক্তিমালিকানাধীন হওয়ায় বিভিন্ন অজুহাতে এসব কেটে ফেলার আগ্রহ দেখা যায়। এই প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় সচেতনতার বিকল্প নেই। গত বৃহস্পতিবারেও টিলার মাটি বহনের অপরাধে একজনকে ৭ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছি।

জানতে চাইলে শিবপুরের সাংসদ জহিরুল হক ভূইয়া বলেন, টিলা কাটার খবরে আমিও উদ্বিগ্ন। আইনের তোয়াক্কা না করে যারা পরিবেশের বিপর্যয় ঘটাচ্ছেন তাদের কোন ছাড় দেওয়া হবে না। আমি জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে এই নিয়ে কথা বলব।

তিনি আরও বলেন, জনস্বার্থ বিবেচনা না করে টিলা কাটার এসব লালমাটি একজন সাবেক সাংসদের সিরামিক কারখানায় যাচ্ছে, এই বিষয়টি মেনে নিতেও খুব কষ্ট হচ্ছে।



এই বিভাগের আরও