ভালোবাসায় ব্যর্থ হয়ে সাবেক প্রেমিককে গলা কেটে হত্যা

১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০১:০৭ পিএম | আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৭ পিএম


ভালোবাসায় ব্যর্থ হয়ে সাবেক প্রেমিককে গলা কেটে হত্যা

আল-আমিন মিয়া:
ভালোবেসেই শ্রাবন্তী আক্তার (২০) কে গত ৬ ফেব্রুয়ারি বিয়ে করেন মো. মাঈনুল মীর (২৩)। দু'জনের পরিবার রাজি না থাকায় গোপনে 'কোর্ট ম্যারেজ' করেন তারা। মাঈনুল মীরের বাড়ি নরসিংদীর পলাশ উপজেলার ঘোড়াশাল পৌর এলাকার দক্ষিণ চরপাড়া গ্রামে। আর শ্রাবন্তীর বাড়ি একই জেলার সদর থানার কামারগাঁও গ্রামে।

তবে কে জানত, বিয়ের মাত্র ৬ দিনের মাথায় পুরোনো প্রেমিকার হাতেই মীরের জীবন যাবে। অন্য মেয়েকে বিয়ের কথা জানতে পেরে কৌশলে মীরকে ডেকে নিয়ে চেতনানাশক ইনজেকশন পুশ করে গলায় ছুরিকাঘাত করে হত্যা করেন তার পুরোনো প্রেমিকা মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ইসরাত জাহান মীম (২০)। শনিবার রাতে মীমকে আটক করে পুলিশ।

তদন্ত সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়েছেন মীমই এ নৃশংস হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। নিহত মাইনুল হক মীর ঘোড়াশাল দক্ষিণ চরপাড়া গ্রামের মৃত আব্দুল ফেলু মীরের ছেলে। আর ইসরাত জাহান মীম উপজেলার ডাঙ্গা ইউনিয়নের খিলপাড়া গ্রামের ইমরান হোসেনের মেয়ে।

গ্রেপ্তারকৃত মীমের তথ্যের বর্ণনা দিয়ে পলাশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ ইলিয়াছ জানান, মীম ও মাইনুল স্কুল জীবন থেকেই একে অপরের পরিচিত। দু'জন স্থানীয় মুসা বিন হাকিম কলেজে একসঙ্গে পড়তেন। একসময় দু'জনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। কিছুদিন পর ওই সম্পর্কে ফাটল ধরে। গত বছরের মাঝামাঝিতে মীম আরেক ছেলেকে বিয়ে করে ফেলেন। তিন মাস পর সেই বিয়ে ভেঙে যায়। এরপর আবার মীরের সঙ্গে পুরোনো সম্পর্ক জোড়া লাগে মীমের। কিন্তু এরই মাঝে শ্রাবন্তীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছেন মাইনুল। গোপনে একই সঙ্গে দু'জনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক চালাতে থাকেন মীর। দু'জনই পরিবারকে না জানিয়ে গত ৬ ফেব্রুয়ারি শ্রাবন্তীকে বিয়ে করেন পেশায় দাঁতের চিকিৎসকের সহকারী মাইনুল। এরপর স্ত্রীকে নিয়ে নিজ বাসায় বসবাস করতে থাকেন। খবর পেয়ে ৭ ফেব্রুয়য়ারি শ্রাবন্তীর বাবা ও ফুফাসহ অন্য স্বজনরা মেয়ের জামাইয়ের বাসায় হাজির হন। তারা মেয়েকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য চাপ দেন। তবে কোনোভাবেই মেয়ে তার বাবার সঙ্গে যেতে রাজি হননি। মেয়েকে ছাড়াই বাসায় ফিরে যান তারা।

বাড়ির অদূরে নিজের কর্ম প্রতিষ্ঠান 'টুথ অফিস' নামে ডেন্টাল ক্লিনিকে যাচ্ছেন জানিয়ে বৃহস্পতিবার বাসা থেকে বের হন মীর। রাতেও বাড়িতে ফেরত না গেলে স্ত্রী ও স্বজনরা কল করে মোবাইল ফোন বন্ধ পান। বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ করে তার সন্ধান না পাওয়ায় স্থানীয় কমিশনারকে তারা বিষয়টি অবগত করেন। কমিশনার ঘটনাটি পুলিশকে অবহিত করতে পরামর্শ দেন। শুক্রবার সকালে স্থানীয় পুলিশকে জানানো হয়।

মাঈনুল মীরের স্ত্রী পুলিশের কাছে তার সন্দেহের কথা জানিয়ে বলেন, পরিবারের অসম্মতিতে বিয়ে করায় বাবা ও ফুফা তার স্বামীর ক্ষতি করতে পারেন। এরপর পুলিশ নানামুখী তদন্ত শুরু করে। মীরের কর্মস্থলেও খোঁজ নেয়। তবে বাইরে থেকে তালাবদ্ধ থাকায় ক্লিনিকের ভেতরে কেউ থাকতে পারেন এমন কোনো সন্দেহ পুলিশের ছিল না। কার কার সঙ্গে মীরের যোগাযোগ ছিল স্থানীয় ও স্বজনদের কাছ থেকে সেই তথ্য নেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এরপর জানা যায়, একই এলাকার তরুণী মীমের সঙ্গে মীরের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। তখন ওই মেয়ের বাড়িতে যায় পুলিশ। তবে মীরের ব্যাপারে তার কাছে কোনো তথ্য নেই দাবি করেন মীম। যদিও প্রযুক্তিগত তদন্তে মীরের সঙ্গে মীমের একাধিক দফায় কথা বলার তথ্য পাওয়া গিয়েছিল। তবে ঘটনার মোড় নেয় গত শনিবার বিকেল ৪ টার পর। ডেন্টাল চিকিৎসক শিহাবুল হক প্রতিষ্ঠানে গিয়ে তালা খোলার পর অভ্যর্থনা কক্ষে মীরকে গলা কাটা অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। হতচকিত হয়ে তিনি দ্রুত পুলিশকে খবর দেন। পুলিশ লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠায়। এর পরই সন্দেহভাজন মীমকে বাসা থেকে আটক করে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এক পর্যায়ে মীম সব স্বীকার করেন।

তিনি জানান, মীরের বিয়ে করার কথা জানতে পেরেই চেতনানাশক ইনজেকশন কেনেন মীম। কৌশলে মীরকে তার কর্মস্থলে ডেকে নেন। কেনো তাকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা রক্ষা করা হলো না, সেটা জানতে চান। এক পর্যায়ে মীরের ঘাড়ে ইনজেকশন পুশ করেন মীম। দু-তিন মিনিটের মধ্যে অচেতন হয়ে পড়েন মাইনুল। এরপর ছুরি দিয়ে গলায় আঘাত করে মাইনুলের মৃত্যু নিশ্চিত করে তালাবদ্ধ করে পালিয়ে যায় মীম। মীমের বর্ণনা অনুযায়ী, মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে চাকরি করায় চেতনানাশক ইনজেকশন ও তা দ্রুত পুশ করার ব্যাপারে তার অভিজ্ঞতা ছিল। ২০ থেকে ৩০ মিনিটের মধ্যে হত্যা মিশন শেষ করেন। এরপর ছুরি, মোবাইল ও সিরিঞ্জ ঘোড়াশাল এলাকার নিকটবর্তী শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দেন।

পলাশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ ইলিয়াছ আরও জানান, নিহত মাইনুল হক মীরের সাথে সাবেক প্রেমিকা ইসরাত জাহান মীমের মধ্যে প্রেমের সম্পর্কের পাশাপাশি শারীরিক সম্পর্কও ছিল। তারা ঘোড়াশাল বাজার এলাকার ওই 'টুথ অফিস' ডেন্টাল ক্লিনিকের মধ্যেই শারীরিক সম্পর্কে মিলিত হতো।

তিনিও আরও বলেন, এ ঘটনায় নিহতের বড় ভাই সাইদুর মীর বাদী হয়ে থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। সেই মামলায় ইসরাত জাহান মীমকে গ্রেপ্তার করে আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে। এ ঘটনায় আরও কেউ জড়িত আছে কি না সে বিষয়েও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলেও জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।



এই বিভাগের আরও