লেখালেখির ক্ষেত্রে কোন শেষ বাঁশি নেইঃ কাজুও ইশিগুরো

১৪ ডিসেম্বর ২০১৭, ০৯:৪৬ এএম | আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:২৩ পিএম


লেখালেখির ক্ষেত্রে কোন শেষ বাঁশি নেইঃ কাজুও ইশিগুরো
ফাহিম ইবনে সারওয়ার

ফিল্মমেকারদের সাক্ষাৎকার অনুবাদ নিয়ে ‘সিনেমার আলাপ’ নামে একটা বই করেছিলাম। সাক্ষাৎকার অনুবাদের মজা হচ্ছে একজন ব্যক্তি সম্পর্কে জানার এবং বোঝার ব্যাপ্তিটা বাড়ে। ফিল্মমেকারদের নিয়ে কাজ শেষ করার পর শুরু করি লেখকদের সাক্ষাৎকার অনুবাদের কাজ। সেটা গত দুবছর ধরে চলছে। যদিও খুবই ধীরগতিতে। কিছু কিছু লেখকদের সাক্ষাৎকার অনুবাদ করে অল্প অল্প করে এগোচ্ছিলাম। কয়েকজন লেখকের নির্বাচিত সাক্ষাৎকার পিসিতে একটা ফোল্ডারে রাখা ছিল। সেই ফোল্ডারে কাজুও ইশিগুরোর একটা সাক্ষাৎকারও রাখা ছিল, তবে সেটায় হাত দেয়া হয়নি। এবার তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। সারা বিশ্বে তাঁকে নিয়ে আলোচনা। সে কারণেই তাঁকে এবং তাঁর লেখালেখি সম্পর্কে জানতে সাক্ষাৎকারটা অনুবাদ করা শুরু করলাম। এখানে পুরো সাক্ষাৎকারটার অর্ধেক আছে। ২০১৫ সালের ১৪ অক্টোবর এই সাক্ষাৎকারটি ছাপা হয়েছিল দ্য টকস ওয়েবসাইটে।

প্রশ্নঃ মিস্টার ইশিগুরো আপনি কি কখনো পুরোনো বইয়ের দোকানে আপনার বই খুঁজে পেয়েছেন?

কাজুও ইশিগুরোঃ হ্যা। এ ব্যপারটা বেশ মুশকিলের। আমি যখন ইংল্যান্ড বা অন্য কোথাও গ্রামের ‍দিকে যাই এবং পুরোনো বইয়ের দোকানে আমার লেখা কোন বই খুঁজে পাই, আমার মনে হয়,‘এটা এক ধরণের অপমান। কোন একজন পাঠক আমার বই তার ঘরে রাখতে চাননি (হাসি)!’ কিন্তু পুরোনো বইয়ের দোকানে যদি আমার বই না থাকে সেটাও আমার কাছে এক ধরণের অপমান মনে হয়! তখন মনে হয়,‘আমার বই কেন পুরোনো বইয়ের দোকানে নেই? পাঠক বা বিক্রেতারা কি তাহলে আমার বইয়ের ব্যপারে আগ্রহী নয়?’

প্রশ্নঃ আপনার কি মনে হয় লেখকদের চামড়া পুরু হওয়া দরকার?

কাজুও ইশিগুরোঃ হ্যা, একটা উদাহরণ দেই। আমার বউ আমার লেখার কঠোর সমালোচক। আমি আমার সর্বশেষ বই ‘দ্য বুরিড জায়ান্ট’ লেখার কাজ শুরু করি ২০০৪ সালে। কিন্তু আমার বউকে এর অংশবিশেষ দেখানোর পর আমি সেটা লেখা বন্ধ করে দেই। তার মনে হয়েছিল লেখাটা স্রেফ আবর্জনা হয়েছে (হাসি)।সমস্যাটা হচ্ছে সে যখন আমার গার্লফ্রেন্ড ছিল তখন আমি লেখক ছিলাম না। আমি ঠিকমত লেখালেখি শুরুর আরো আগে থেকে ওর সাথে প্রেম করি। তাই ও যখন আমার কোন লেখা পড়ে ও ভাবে যে আমি এখনও সেই পোস্ট গ্র্যাজুয়েটের একজন ছাত্র যে ভাবে সে একদিন লেখক হবে।

প্রশ্নঃ বুকার পুরস্কার জেতার পরেও?

কাজুও ইশিগুরোঃ এগুলোকে সে একদমই পাত্তা দেয় না!এবং আমি যখন প্রথম লেখা শুরু করি বা আমার প্রথম বই প্রকাশের পর সে যেমন কঠোরভাবে আমার লেখার সমালোচনা করতো এখনও তাই করে। তাকে খুব কঠোর হতে হয়। আমরা আমার বই নিয়ে তর্ক করি, অন্যদের লেখা নিয়ে আলোচনা-তর্ক করি। সিনেমা বা কোন মঞ্চ নাটক দেখে আসার পর সেটা নিয়েও আলোচনা করি। এটা সেই ১৯৮০ সাল থেকে অর্থ্যাৎ ১৫ বছর ধরে এভাবেই চলে আসছে। কিছু বিষয় আছে যেগুলো আমি ওর সাথে একমত আবার কিছু বিষয়ে সবসময়ই দ্বিমত পোষণ করি। ওর কিছু পর্যবেক্ষণ থাকে যেগুলোকে আমি কখনোই সিরিয়াসলি নেই না। আবার এমন কিছু পর্যবেক্ষণ আছে যেগুলো আমি খুব সিরিয়াসলি নেই। কিছু বিষয় আছে যেগুলো ও খুবই ভালো বোঝে।

প্রশ্নঃ কিন্তু আপনি তো কখনো নিজের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে আপোস করেন না।

কাজুও ইশিগুরোঃ না আমি কখনো অপরিহার্য বিষয়ে আপোস করি না, লেখার মূলভাব আমি সবসময় যা ভেবেছি সেটাই রাখি। আমার বউ আমার লেখার সমালোচনা করছে সেটা মূল ব্ষিয় না, মূল বিষয় হচ্ছে আমি লেখাটা কীভাবে লিখছি। ও সাধারণত বলে থাকে,‘তুমি লেখাটা ঠিকভাবে শেষ করোনি। আমি জানি তুমি কি লিখতে চাইছো, কিন্তু সেটা তুমি করতে পারোনি’।তবে ও কখনো বলে না যে,‘তোমার পুরো লেখাটাই ভুল’।

প্রশ্নঃ তাহলে বউয়ের কথা শুনে আপনি ‘দ্য বুরিড জায়ান্ট’ বইটা লেখা থামিয়ে দিলেন কেন? আপনি ১০ বছর আগে বইটা লেখার কাজ শুরু করেছিলেন।

কাজুও ইশিগুরোঃ আমি প্রায়ই উপন্যাস লেখার কাজ শুরু করে কয়েক বছর বন্ধ রাখি। আমার আগের উপন্যাস ‘নেভার লেট মি গো’ আমি তিনবারের চেষ্টায় শেষ করতে পেরেছি। আমি আমার এই থেমে থেমে লেখার ব্যপারটাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কিছু অংশ লিখে রেখে দেই। দুই বা তিন বছর পর আবার লেখা শুরু করি। এর মধ্যে কিছু পরিবর্তন আসে। সাধারণত দেখা যায় আমি যে গল্পটা কল্পনা করেছি পরিবেশ, পরিস্থিতি ও সময়ের কারণে সেখানে কিছু পরিবর্তন আসে। বা বিরতির পর আমার মনে হয় যে আমি ভিন্নভাবে এটা লিখতে পারি এখন। গল্প বা লেখার ভাবটা একই থাকে কিন্তু এই বিরতির কারণে আলাদা একটা তাৎপর্য তৈরি হয়। এরকম আমার ক্ষেত্রে আগেও হয়েছে। তাই যখন লেখা পড়ে কেউ বলে,‘এটা কিছুই হয়নি’। তখন আমি মোটেও উদ্বিগ্ন হই না । কারণ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আমি জানি এটা বরং ভালোই হবে লেখার জন্য।

প্রশ্নঃ যখন আপনি একটা বই শেষ করেন তখন অনুভূতি কেমন হয়?

কাজুও ইশিগুরোঃ এ বিষয়ে কথা বলাটা হাস্যকর। কারণ আমার কখনো এমন মুহূর্ত আসেনি যখন আমার মনে হয়েছে,‘যাক! শেষ করলাম!’ আমি দেখি যে ফুটবল ম্যাচে ফুটবলাররা তাদের সবটুকু একাগ্রতা দিয়ে খেলে কিন্তু যখন শেষ বাঁশিটা বাজে তখন তাদের সেই স্পৃহা কমে যায়। কেউ জয়ের আনন্দে ভেসে যায় কেউবা পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে মাঠ ছাড়ে। কিন্তু এভাবে শেষ করার বিষয়টা লেখকদের জন্য হাস্যকর। কারণ লেখালেখির ক্ষেত্রে কোন শেষ বাঁশি নেই।

প্রশ্নঃ কেন নেই?

কাজুও ইশিগুরোঃ নেই কারণ, আমার বই প্রকাশিত হওয়ার পরও কিছু বিষয় পরিবর্তিত হতে থাকে। যেমন ধরুন আমার একটা বইয়ের ব্রিটিশ সংস্করণ বের হল হার্ডকভারে। এরপর সেটা অনুবাদের জন্য অনুবাদকরা যোগাযোগ করেন, তারা বিভিন্ন খুঁটিনাটি বিষয়ে জানতে চান। আমি তাদের জিজ্ঞাসা এবং মন্তব্যগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনি। তারপর আমার যদি মনে হয় কোথাও কিছুটা পরিবর্তন করলে আরো ভালো হবে তখন সেটা করি। দেখা যায় পেপারব্যাক সংস্করণে কিছু পরিবর্তন এসেছে। যখন পেপারব্যাক সংস্করণ বের হয় তখন আমার মনে হয় যে এটাই বুঝি চূড়ান্ত আর কোন পরিবর্তন করতে হবে না। কারণ তখন পরিবর্তন করার সময়টাও আর থাকে না। তবে এই প্রক্রিয়াকে আপনি কোন নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে আটকে রাখতে পারবেন না।



এই বিভাগের আরও