গণমানুষের সাহিত্যিক সোমেন চন্দ

১১ ডিসেম্বর ২০১৭, ০৮:৪৭ এএম | আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৪৩ পিএম


গণমানুষের সাহিত্যিক সোমেন চন্দ
সিদ্ধার্থ রাহা ইতিহাস প্রায় সময়ই প্রতিভাবানদের ধারণ করতে ব্যর্থ হয়। অনেক প্রতিভা আছে যারা সামাজিক প্রতিকূলতা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সঠিক ভাবে বিকাশের সুযোগ পায় না। আবার কেউ আছে সকল প্রতিকূলতার মধ্যেও যেটুকু সুযোগ পায় তা নিয়েই সে তার প্রতিভা বিকাশের পথে যাত্রা শুরু করে এবং প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে যেতে সক্ষম হয়। অনেক ক্ষেত্রে সে প্রতিভা জাতীয় মানের ঊর্ধ্বে হয়ে ওঠে বিশ্ব প্রতিভা। সেরকমই একটি বিকাশমান বিশ্বপ্রতিভা সোমেন চন্দ। যে বাংলা সাহিত্যের রবীন্দ্রনাথ, শরতচন্দ্র, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, মানিকের পাশাপাশি পড়তে আগ্রহী হয়ে ওঠে বিশ্ব সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের সাহিত্য। টি.এস. এলিয়ট, অডেন, স্টিফেন স্পেন্ডারের মত কবির কবিতা এবং ভার্জিনিয়া উলফ, অলডাস হাক্সলি, ই.এম. ফর্স্টার, হেমিংওয়ে, ম্যাক্সিম গোর্কি, শলোখভ, লুডভিগ রেনে, আদ্রে জিদ প্রভৃতি ঔপন্যাসিকের লেখা পড়ে অনুপ্রানিত হয়। রেলফ ফক্স, জন কর্ণফোর্ড, জুলিয়ান বেল, ক্রিস্টোফার কডওয়েল প্রভৃতি সাহিত্যিকদের আত্মত্যাগ তাকে আলোড়িত করে। কৃষক, শ্রমিক, মেহনতী মানষদের উপর সাম্রাজ্যবাদ, বুজোর্য়া পুজিঁবাদ ও ফ্যাসিবাদের জুলুম, অত্যাচার, শোষণ, নির্যাতন যাকে কষ্ট দেয়। সৌখিন সাহিত্যের বিপরীতে গণমানুষের ও মার্কসবাদী সাহিত্যের চেতণা সে হৃদয়ে ধারণ করে তার সাহিত্য চর্চা শুরু করে। গণমানুষের মুক্তির লক্ষ্যে সাহিত্যের পাশাপাশি কৃষক-শ্রমিকের কাঁধে কাঁধ রেখে রাজপথে নেতৃত্ব দেয় গণআন্দোলনের। সেই সোমেন চন্দকে ফ্যাসিবাদী শাসকগোষ্ঠী মাত্র একুশ বছর নয় মাস পনের দিন বয়সে অত্যÍ নৃশংসভাবে হত্যা করে। এই অল্প সময়ের মধ্যেই সোমেন সাহিত্যচর্চায় বেশকিছু অনবদ্য সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। তার “ইঁদুর” গল্পটি বিশ্ব সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পের মধ্যে অন্যতম। রাজনৈতিক কর্মকান্ডেও সোমেন তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। মাত্র একুশ বছর বয়সে সোমেন কমিউনিস্ট পার্টি সদস্যপদ লাভ করে এবং ই.বি.রেলওয়ে ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সে তার দায়িত্ব পালন করে। বাংলা সাহিত্যে প্রতিভাবান কমবয়সী সাহিত্যিকদের মধ্যে সুকান্ত যেমন কবিতায় বিখ্যাত তেমনি সোমেন বিখ্যাত ছোটগল্পে। সোমেনের মত প্রতিভাবান কথাসাহিত্যিক বাংলা সাহিত্যে ও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আজও অবহেলিত। এই প্রতিভাবান কথাসাহিত্যিক সোমেন চন্দ ১৯২০ সালের ২৪ মে ততকালীন ঢাকা জেলার টঙ্গি থানার আশুলিয়া গ্রামে তাঁর মাতুতালয়ে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার আদি নিবাস ছিল বর্তমান নরসিংদী জেলার পলাশ উপজেলার চরসিন্দুর ইউনিয়নের বালিয়া গ্রামে। তাঁর পিতার নাম নরেন্দ্রকুমার, মাতা হীরণবালা। মাত্র চার বছর বয়সে সোমেন তার জন্মদায়ী মাকে হারায়। পরবর্তীতে তাঁর পিতা ছোট্ট সোমেনের প্রতিপালন করার জন্য দ্বিতীয় বিয়ে টঙ্গির নিকটবর্তী ধউর গ্রামের ডাক্তার শরতচন্দ্র বিশ্বাসের মেয়ে সরযূবালাকে। প্রকৃতপক্ষে এই সরযূবালাই সোমেনকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা পালন করেন। সোমেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হওয়ার পর তাঁর কাছে অনেক গোপন কাগজপত্র থাকতো, তাঁর মা সেইসব কাগজপত্র অত্যন্ত যতœ সহকারে লুকিয়ে রাখতেন। ম্যাক্সিম গোর্কির “মা” উপন্যাসের পাভেলের মা’র চরিত্রের সাথে সোমেন তাঁর মা’র তুলনা করেছেন। সোমেনের অনেক গল্পেই তা ফুটে উঠেছে। সোমেন প্রাথমিকভাবে রাজনৈতিক শিক্ষা লাভ করে তাঁর পিতা নরেন্দ্রকুমারের কাছ থেকেই। তাঁর পিতা পুলিন দাসের আখড়ায় যোগদানের মাধ্যমে ততকালীন সময়ে বিপ¬বী রাজনৈতিক শিক্ষা লাভ করেন এবং বিপ¬বী বিপিন পালের অনুবর্তী হয়ে সক্রিয় রাজনীতি শুরু করেন। সাহিত্য পড়া ও চর্চা এবং রাজনৈতিক মিক্ষা সোমেন পরিবার থেকেই পায়। একটু আধটু লেখালেখিও সোমেন ছোটসময় থেকেই শুরু করেন। সোমেনের সাহিত্য চর্চা এবং রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনাই পরবর্তী সময়ে তাকে গণসাহিত্য ও বিপ্ল¬বী রাজনীতির দিকে আকৃষ্ট করে। সোমেনের বই পড়ার অভ্যাস তাকে টেনে নিয়ে যায় কমিউনিস্ট পার্টির একমাত্র প্রকাশ্য সংগঠন প্রগতি পাঠাগারে এবং পরিচয় ঘটে নরসিংদীর আন্দামান ফেরত প্রবীণ বিপ্লবী সতীশ পাকড়াশীর সাথে। একদিন সন্ধ্যায় বুড়িগঙ্গার তীরে বসে সতীশ পাকড়াশী সোমেনকে বলেছিলেন, “মহত কর্মপ্রেরণায় আত্মদান বৃথা যায় না। বিশ্বমানবের কল্যাণে ইংল্যান্ডের তরুণ বিপ্লবী সাহিত্যিক রেলফ ফক্সের আত্মদান গণমানুষের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। অত্যাচার যখন চরমে উঠে, মানবতার বিকাশ যখন রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়, তখন কলম ছেড়ে তরবারি ধরতে হয়। বুকের রক্তে তখন নতুন সাহিত্য তৈরী হয়। ধন-শোষণ-মদমত্ত ফ্যাসিস্ট বর্বরতার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে কবি সাহিত্যিকগণ তাই স্পেনের আন্তর্জাতিক বাহিনীতে ছুটে গিয়েছিলেন। সাহিত্য সাধনায় লাঞ্ছিত গণমানবের মর্মকথা ফুটিয়ে তোলবার যে প্রেরণা, সেই প্রেরণাই লেখককে গণমানবের মুক্তিসংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ার শক্তি দিয়েছে।” সোমেন চুপ করে শুনে একটু পরে বলল, “এরাই সত্যিকারের সাহিত্যিক।” সেদিন রাত্রে সোমেন তার তরুণ বন্ধুদের নিয়ে নতুন সাহিত্যের কথা বলতে বলতে বাড়ি ফিরলেন। সেদিন রাত্রের সেই কথাবার্তাই সোমেনকে সম্পূর্ণরপে পরিবর্তন করে দেয়। দক্ষিণ মৈশুন্ডি প্রগতি পাঠাগারের নিয়মিত পাঠচক্রের আলোচিত বিষয়গুলো সোমেন মনযোগ দিয়ে শুনত এবং সেই আলোচনার ছাপ পড়ত তার লেখায়। পরবর্তীতে সোমেনের বাসায়ই মার্কসবাদের ক্লাস শুরু হয় এবং তার মা ও মাসী বীণা বিশ্বাসও সেই আলোচনায় উপস্থিত থাকতেন। সোমেনের বাসায় ক্লাস শেষ করে সতীশ পাকড়াশী সবসময়ই তাঁর পড়াশুনা ও লেখালেখির খোঁজখবর নিতেন। সামগ্রিকভাবেই সোমেনের চিন্তা চেতনায় বিশাল পরিবর্তন আসে। সোমেন তাঁর বন্ধুদেরকেও তাঁর চেতনায় গড়ে তোলার প্রচেষ্টা শুরু করে। অমৃতকুমার দত্তকে লেখা চিঠিতে সোমেন সে কথাই বলেছিলেন। চিঠির অংশবিশেষ, লিখতে হবে, মেহনতী মানুষের জন্য, সর্বহারা মানুষের জন্য আমাদের লিখতে হবে। রেলফ ফক্সের বই পড়ে আমি অন্তরে অনুপ্রেরণা পাচ্ছি। কডওয়েলের বইটিও আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। এই না-হলে কি মহত সাহিত্যিক হওয়া যায়? স্পেনের পপুলার ফ্রন্ট সরকারের সমর্থনে তাদের আত্মবিসর্জন ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। আশার কথা সাহিত্যে তরুণ লেখকরা এদিকে সচেতন হচ্ছেন। বিপ্ল¬বের জন্য একজন তরুণ লেখক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। আমাদেরকেও সেভাবে প্রস্তুত হতে হবে। গোর্কির কথাই চিন্তা করো। সৌখিন সাহিত্য করার আর সময় নেই। সোমেন ও রনেশ দাশগুপ্তের প্রচেষ্টায় ১৯৪০ সালে “প্রগতি লেখক-শিল্পী সংঘ” গঠিত হয়। প্রবীণ সাহিত্যিক কাজী আব্দুল অদুদকে সভাপতি, রনেশ দাশগুপ্তকে সম্পাদক এবং সোমেনকে সহ-সম্পাদক (পরবর্তীতে সোমেন সম্পাদক নির্বাচিত হয়) নির্বাচিত করা হয়। পরবর্তীতে কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত, অমৃতকুমার দত্ত, সত্যেন সেন, সতীশ পাকড়াশীসহ আরো অনেকে এসে প্রগতি লেখক শিল্পী সঙ্ঘে যোগ দেয়। সোমেনের বন্ধুরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নারী জীবনের মাধূর্য এবং পান্ডিত্যপূর্ণ সমালোচনামূলক প্রবন্ধ লিখতো। প্রগতি লেখকদের দলে ভিড়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন হয়, তারা ক্রমে ক্রমে বাস্তবধর্মী হয়ে উঠলো আত্মগত ভাবসৃষ্টির স্থানে বস্তুগত ভাবপ্রকাশের দ্যোতনা হলো তাদের মনে, সমাজ মনের সত্যিকার পরিচয় রূপায়িত হয়ে উঠলো তাদের নতুন লেখায়, ভাবধারায়, চিন্তায় ও আলোচনায়। এক কথায় সকলেই গণমানবের দরদী সাহিত্যিক হয়ে পড়লো। সোমেন ঐ দলের অগ্রণী কর্মীরূপে তাদের আগে আগে চলেছিল। সোমেন চন্দের অধিকাংশ লেখাই প্রগতি লেখক সংঘের মুখপাত্র ‘ক্রান্তি’সহ ঢাকা ও কলকাতার বিভিন্ন মাসিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পরবর্তী সময়ে তার অনেক লেখাই হারিয়ে যায়। বর্তমানে তাঁর লেখা চব্বিশটি গল্প, তিনটি কবিতা, দুটি একাঙ্কিকা, একমাত্র উপন্যাস ‘বন্যা’ ও কিছু চিঠিপত্র সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। সোমেনের ‘ইঁদুর’ ও ‘সংকেত’ গল্পদুটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন অশোক মিত্র ও লীলা রায়। বাংলা একাডেমী বিশ্বজিত ঘোষের সম্পাদনায় সোমেন চন্দের রচনা সমগ্র ও হায়াত মামুদের লেখা সোমেনের জীবনী প্রকাশ করে। বিশ্ব সাহিত্য ভবন শিকড় সন্ধানী মৌলিক গবেষক ও সৃজনশীল সাহিত্যিক ড. সফিউদ্দিন আহমদের লেখা “সোমেন চন্দ: মার্কসবাদী বিপ¬বী ও সাহিত্যিক” প্রকাশ করে। এছাড়াও ঢাকা ও কলকাতা থেকে সোমেন চন্দের গল্প সংকলন এবং সোমেন চন্দকে নিয়ে বেশকিছু স্মারক গ্রন্থ প্রকাশ করা হয়েছে। সোমেনকে চিনতে হলে সোমেনের সাহিত্যকে চিনতে হলে জানতে হবে সমসাময়িক কালকে। জানতে হবে সে সময়ের রাজনৈতিক ও সাহিত্যিক ইতিহাস। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে পুজিঁবাদের চরম সংকট থেকে ফ্যাসিবাদের (জর্জি ডিমিট্রভ ১৯৩৫ সালে কমিণ্টার্নের সপ্তম কংগ্রেসে ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে বলেন, “ফ্যাসিজম সবচেয়ে চরম সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থেই কাজ করে। কিন্তু একটা নিপীড়িত জাতির স্বার্থরক্ষকের ছদ্মবেশে তারা জনসাধারণের সামনে হাজির হয়। জনসাধারণকে অবাধে শোষণ করাই ফ্যাসিজমের লক্ষ্য। কিন্তু দস্যু বুজোর্য়াশ্রেণী, ব্যাঙ্ক, ট্রাস্ট ও রাঘববোয়াল পুজিঁপতিদের বিরূদ্ধে জনসাধারণের যে সুগভীর ঘৃণা রয়েছে, তার সুযোগ নিয়ে অত্যন্ত সুকৌশলে পুজিঁবাদবিরোধী গলাবাজি করে তারা জনসাধারণের কাছে আবেদন জানায়, এমন সব দাবি উপস্থিত করে, যা রাজনৈতিকভাবে অপরিপক্ক জনসাধারণের কাছে সেই মুহুর্তে সবচেয়ে লোভনীয় বোধ হয়। জার্মানিতে -‘সমষ্টির মঙ্গল ব্যক্তির মঙ্গলের ঊর্ধ্বে’; ইতালিতে -‘আমাদের রাষ্ট্র পুজিঁবাদী রাষ্ট্র নয়, যৌথ (কপোরেট) রাষ্ট্র’; জাপানে ‘শোষণমুক্ত জাপান গঠনের জন্য’; আমেরিকায় -‘ধনসম্পদ অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নিতে হবে’; ইত্যাদি হচ্ছে তাদের বুলি।) জন্ম, আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট পার্টির উত্থান, ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে উত্তাল সমগ্র বিশ্ব, অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চলছে প্রস্তুতিপর্ব, সারা ভারতবর্ষে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে; এই পরিস্থিতিতে সোমেন শ্রমিকশ্রেণীর স্বার্থে শ্রমিকশ্রেণীর সাথে একাত্মতা পোষণ করে তাদের সাথে আন্দোলনে নামে। অপরদিকে তারাশঙ্কর বিভূতিভুষণ -মানিক বাংলা কথাসাহিত্যে গণসাহিত্যের যে নতুন ধারা তৈরীর প্রচেষ্টায় ব্যস্ত মার্কসবাদী আদর্শে উজ্জিবীত সোমেন গণ সাহিত্যের সে ধারাকেই এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তার লেখা ‘ইঁদুর’, ‘সংকেত’, ‘দাঙ্গা’, ‘রাত্রিশেষ’, ‘স্বপ্ন’, ‘একটিরাত’, অন্ধ শ্রীবিলাসের অনেক দিনের এক দিন’ প্রভৃতি গল্পে এবং তার একমাত্র উপন্যাস ‘বন্যা’ তার প্রমাণ। অসাম্প্রদায়িক মানসপ্রবণতা সোমেন চন্দের জীবনদৃষ্টির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সোমেন ছিলেন কমিউনিস্ট-তাই তথাকথিত কর্মচিন্তা থেকে প্রথম থেকেই মুক্ত। প্রথাবদ্ধ ধর্ম নয়, মানব ধর্মই ছিল তার কাছে প্রধান আচরনীয় বিষয়। চল্লিশের দশকের প্রথমদিকে ঢাকাসহ সারা ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যখন চরমে তখন প্রগতি লেখক সংঘ থেকে সবাইকে দাঙ্গা বিষয়ে লেখার জন্য তাগিদ দেয়া হয়। সেই সময় সোমেন উপস্থাপন করে তার দাঙ্গা বিরোধী ছোটগল্প ‘দাঙ্গা’। যা আজও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে দাঙ্গা বিরোধী শ্রেষ্ঠ ছোটগল্প হিসেবে অগ্রগণ্য। ১৯৪১ সালের ২২ জুন হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়নকে আক্রমণ করে। বিশ্বযুদ্ধ নতুন দিকে মোড় নেয়। উপমহাদেশের প্রগতিবাদী শক্তিগুলো ফ্যাসিস্ট হিটলারের বিরুদ্ধে স্তালিনের নেতৃত্বে সংগ্রামরত দেশপ্রেমিক সোভিয়েত বাহিনীর প্রতি তাদের সমর্থন জানায়। ২১ জুলাই প্রগতি লেখক সঙ্ঘের উদ্যোগে কলকাতা টাউন হলে এক প্রতিবাদ সমাবেশের মধ্য দিয়ে ‘সোভিয়েত সুহৃদ সমিতি’ গঠন করা হয়। ঢাকায়ও প্রগতি লেখক সঙ্ঘের উদ্যোগে গড়ে ওঠে ‘সোভিয়েত সুহৃদ সমিতি’। ১৯৪২ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকায় এই সমিতি গঠিত হয়। সমিতির উদ্যোগে ব্যাপ্টিস্ট মিশন হলে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি নিয়ে চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। এর উদ্বোধন করেন ড. মুহম্মদ শহীদুল¬াহ। এই চিত্র প্রদর্শনীতে সোমেন ছিলেন অনন্য। ১৯৪২ সালের ৮ মার্চ ‘সোভিয়েত সুহৃদ সমিতি’র উদ্যোগে ঢাকার সূত্রাপুরে সেবাশ্রম প্রাঙ্গণে ফ্যাসিবাদ বিরোধী সম্মেলনের আহবান করা হয়। সমিতির প্রাদেশিক সম্পাদক ও ট্রেড ইউনিয়ন নেতা জ্যোতি বসুসহ কলকাতা ও ঢাকার আরো অনেক বিথ্যাত রাজনৈতিক নেতা ও প্রগতিশীল সাহিত্যিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। এই সম্মেলনে যোগ দেয়ার জন্য রেলওয়ে ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের একটি বিশাল মিছিল সোমেন চন্দের নেতৃত্বে বেড়িয়ে আসে। মিছিলটি নারিন্দা পুলের কাছে পৌঁছলে ফ্যাসিবাদীগোষ্ঠী মিছিলকে ছত্রভঙ্গ করে দিয়ে সোমেনকে ঘিরে ধরে এবং নির্মমভাবে হত্যা করে জ্ঞান চক্রবর্তী সোমেনকে হত্যার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে -“এরা বেছে নেয় সোমেনকে। ভোজালি দিয়ে আঘাত তরে তাকেঁ মাটিতে ফেলে দেয়, চোখ দু’টি উপড়ে ফেলে, জিভ টেনে বের করে তা কেটে দেয়, পেট চিরে নাড়িভুড়ি বের করে দেয় এবং অট্টহাস্য করে পশুর মতো তারা ছিন্নভিন্ন দেহের উপর নাচতে থাকে। যতক্ষণ পর্যন্ত ক্ষমতা ছিল, সোমেন ¯ে¬াগানের পর স্লোগান দিয়ে যাচ্ছিলেন, শেষ পর্যন্তও রক্তপতাকা তার হাত থেকে কেড়ে নেয়া সম্ভব হয়নি”। সোমেনের প্রতিভা সম্পর্কে বলতে গিয়ে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃত মুজফফর আহমদ বলেছেন -“সোমেন চন্দ বিশের কোঠায় পা দিতে না দিতে ঘাতকের ছোরার আঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন। তখন আমি আমাদের বে-আইনী পার্টির সভ্য হিসেবে গা-ঢাকা দিয়েছিলাম। সোমেন চন্দের নাম জানা ছিল, কিন্তু তাকে কখনও দেখিনি, কিংবা তখন তার কোনো লেখা পড়িওনি। পার্টি যখন আইন সম্মত হোলো তখন বাইরে এসে সোমেন চন্দের লেখা ‘ইঁদুর’ গল্পটি পড়লাম। আমার মন তখন হাহাকার করে উঠলো। হায় হায়, এমন ছেলেকে রাজনীতিক মন কষাকষির জন্য প্রতিদ্বন্দ্বীরা মেরে ফেললো। সোমেন বেঁচে থাকলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একটি বিরাট স্তম্ভ গড়ে তুলতে পারতেন। তাঁর ছোটগল্প ‘ইঁদুর’ এর ইংরেজি তর্জমা করেচেন শ্রী অশোক মিত্র আই.সি.এস। এই গল্প পৃথিবীর বহু ভাষায় অনুবাদিত হয়েছে। এবং লক্ষ লক্ষ লোক তা পড়েছেন। ‘ইঁদুর’ জগতের একটি শ্রেষ্ঠ ছোটগল্প”। সাতচল্লি¬শ পরবর্তী সময়ে প্রগতিশীল গণসাহিত্যের প্রতি যাদের আগ্রহ তৈরী হয় তাদের মধ্যে অধ্যাপক মুনীর চৌধুরিসহ অনেকেই সোমেনকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন। বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটেও সোমেন চর্চা যে কতখানি প্রাসঙ্গিক নিমাই ঘোষের কথাতেই তা পরিষ্কার। নিমাই ঘোষ বলেন -“আজকের পরিপ্রেক্ষিতে সোমেন চন্দ যে কতখানি প্রাসঙ্গিক তা বর্তমান প্রেক্ষাপট বিচার করলে বোঝা যায়। তাই সোমেন চন্দের আত্মত্যাগ, তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতা এবং প্রগতিশীল লেখা আজও আমাদের মনে, শ্রমজীবী মানুষের মনে প্রেরণার উৎস। সেই উতসকে জাগরুক রাখার দায়িত্ব সমাজের প্রিিতটি সচেতন মানুষের”। সাধারণ সম্পাদক সোমেন চন্দ পাঠাগার পলাশ ,নরসিংদী।


এই বিভাগের আরও