রায়পুরায় ৭ বছর পর নদী খননের মাটি বিক্রির নিলাম, বিপাকে কৃষকরা

২৬ জুন ২০২৫, ০৭:৫৫ পিএম | আপডেট: ২৭ জুন ২০২৫, ১২:৪৪ এএম


রায়পুরায় ৭ বছর পর নদী খননের মাটি বিক্রির নিলাম, বিপাকে কৃষকরা

নিজস্ব প্রতিবেদক:

নরসিংদীর রায়পুরায় আড়িয়াল খাঁ নদ খননের দীর্ঘ ৭ বছর পর কৃষকের জমিতে রাখা মাটি নিলামে বিক্রি করেছে উপজেলা প্রশাসন। ভুক্তভোগী কৃষকদের অবহিত না করাসহ প্রচারণা ছাড়াই হওয়া এ নিলামে ৭০ পয়সা ফুট দরে মাটি কিনে নিয়েছেন ফিরোজ আল মোজাহিদ নামে উপজেলা মৎস্যজীবী দলের এক নেতা ও আক্তার মিয়া নামে উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের অপর এক নেতা। নিলামের পর বাজার দর ৭-৮ টাকা ফুট হিসেবে এসব মাটি বিক্রি করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা।

এতে বিপাকে পড়েছেন জমিতে কলা বাগান, পেয়ারা বাগান, কৃষিফসল রোপনসহ ও বাড়িঘর তৈরি করা কৃষকরা। কৃষি ফসল ও বাড়িঘর রক্ষায় ওই নিলাম বাতিলের জন্য জেলা প্রশাসক ও উপজেলা প্রশাসনের নিকট লিখিত আবেদন জানিয়েছেন ভুক্তভোগী ৮ জন কৃষক।

কৃষকরা জানান, ২০১৮ সালে সরকার জেলার বিভিন্ন নদ নদীসহ রায়পুরার মরজাল ইউনিয়নের চরমরজাল এলাকায় আড়িয়াল খাঁ নদ খনন করে। খননের এসব মাটি অলিখিত চুক্তিতে জমির ভাড়া দেয়াসহ মাটির ৪০ শতাংশ কৃষকদের দেয়ার কথা বলে রাখা হয় নদী তীরের কৃষকদের জমিতে।

খননের এসব মাটি রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কাজে ব্যবহারে অগ্রাধিকারের কথা থাকলেও সেসময় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীসহ প্রভাবশালীরা প্রশাসনের চোখের সামনেই অবাধে বিক্রি করে হাতিয়ে দেন লাখ লাখ টাকা। অনেক কৃষক নিজেদের কৃষিজমির উন্নয়ন ও বাড়িঘর নির্মাণের জন্য সেসব মাটি বিক্রি না করে নিজ জমিতে রেখে দেন।

সরেজমিন মরজাল ইউনিয়নের চরমরজাল গ্রামে গেলে ভুক্তভোগী কৃষকরা জানান, ৭ বছর আগে মাটি রাখা এসব ব্যক্তিমালিকানা জমিতে পেয়ারা বাগান, আমবাগান, কলাবাগানসহ কৃষিফসল ও অনেকে বাড়িঘর তৈরি করে বসবাস করছেন। ৭ বছর পর হঠাৎ করে জানতে পারেন তাদের এসব জমির মাটি নিলামে বিক্রি করে দিয়েছেন রায়পুরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। ৭০ পয়সা ফুট দরে নিলামে কেনা এসব মাটি ৮ টাকা ফুট দরে বিক্রি করবেন বলে কৃষকদের জানান নিলাম পাওয়া উপজেলা মৎস্যজীবী দলের সভাপতি ফিরোজ আল মোজাহিদ ও উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহবায়ক আক্তার মিয়া। কৃষকরা প্রয়োজনে বাজার দর ৭ থেকে ৮টাকা ফুট হিসেবে মাটি না কিনলে এসব মাটি অন্যত্র বিক্রি করে দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন নিলামকারী ওই নেতারা।

চরমরজাল গ্রামের খোরশেদ আলম, নূরুল ইসলাম, আব্দুল মান্নান, আব্দুল হান্নান, আল মামুন, আমজাদ হোসেনসহ ভুক্তভোগী কৃষকরা বলেন, আমাদের জমিতে দীর্ঘদিন পরে থাকা এসব মাটি আমরা ইচ্ছা করলে তখনই অন্যদের মত বিক্রি করে দিতে পারতাম। বিক্রি না করে কৃষি ফসল, পেয়ারা বাগানসহ বাড়িঘর করে বসবাস শুরু করছি। এতো বছর পর সরকার যদি এসব মাটি নিয়ে নেয়, সেক্ষেত্রে আমরা সরকারি দামে এসব মাটি কিনে নিতে প্রস্তুত। এছাড়া নিয়ম অনুযায়ী ৪০ শতাংশ মাটি আমরা পাবো বলে জানতাম। কিন্তু আমাদের না জানিয়ে এসব মাটি নিলামে বিক্রি করায় আমরা ঘরবাড়ি ও ফসল নিয়ে বিপাকে পড়েছি। কৃষকরা নিলামকারী ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ করলে তাদের বেঁধে দেয়া ৮টাকা ফুট হিসেবে মাটি কিনে নিতে না পারলে তাদের কিছু করার নেই বলে জানান। পরে ওই নিলাম বাতিল করে ভুক্তভোগী কৃষকদের কাছে মাটি বিক্রির দাবি জানিয়ে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত আবেদন জানিয়েছি।

উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক নদী পুন:খনন প্রকল্পের আওতায় রায়পুরা উপজেলার মরজাল ও চর আড়ালিয়া ইউনিয়নের ৬টি স্পটে অব্যবহত স্তুপকৃত ৫৩ লাখ ৭ হাজার ২ শত ঘনফুট মাটি/বালু সরকারি সম্পদ হিসেবে নিলামে বিক্রি করা হয়। গত ৪ জুন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে এ নিলাম অনুষ্ঠিত হয়।

এ নিলামের মাধ্যমে চর মরজাল উত্তরপাড়ায় কৃষকদের জমির ৪ নং স্পটে/ডাইকে ফিরোজ আল মোজাহিদ ৮৮ হাজার ৪ শত ঘনফুট মাটি/বালু কিনেন ৬১ হাজার ৮৮০ টাকায় এবং ৫ নং স্পটে/ডাইকে আক্তার হোসেন ৪ লাখ ৮৩ হাজার ঘনফুট মাটি/বালু কিনেন ৩ লাখ ৩৮ হাজার ১ শত টাকায়।  

নিলামে মাটি ক্রেতা উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহবায়ক আক্তার হোসেন বলেন, আমার নামে কেনা হলেও, মূলত আমার সাথে আরও অংশীদার আছেন। উন্মুক্ত নিলামে ৭০ পয়সা দরে আমরা মাটিগুলো কিনেছি। যদি কৃষকরা কিনতে চান, তাহলে তাদের ছাড় দেয়া হবে।

উপজেলা মৎস্যজীবী দলের সভাপতি ফিরোজ আল মোজাহিদ বলেন, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ডাকে মাটি কিনেছি। আমি স্পটে এখনও যাইনি, সেখানে ঠিক কী পরিমান মাটি আছে ঠিক জানি না। যদি কৃষকদের মাটি থেকে থাকে সেক্ষেত্রে বৈধভাবে যা করার তা করব।

যোগাযোগ করা হলে রায়পুরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: মাসুদ রানা বলেন, জেলা প্রশাসকের নির্দেশে নিয়ম অনুযায়ী পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশসহ সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তার মাধ্যমে প্রচারনার পর নিলামে মাটি বিক্রি করা হয়েছে। নিলামের বিষয়টি কৃষকরা কেন জানতে পারলেন না বুঝতে পারছি না। পরে ভুক্তভোগী কৃষকরা দেখা করে এসব জমিতে কৃষি ফসল ও ঘরবাড়ি রয়েছে বলে আমাকে জানিয়েছেন। নিলাম পাওয়া ব্যক্তিরাও না কী অতিরিক্ত দামে মাটি বিক্রি করতে চাইছেন। কীভাবে বিষয়টি সমাধান করা যায় ভাবা হচ্ছে।

সরকারের রাজস্ব আদায়ের স্বার্থে নিয়ম মেনে নিলাম করা হয়েছে জানিয়ে এর বাইরে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি নরসিংদীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো: নাজমুল হাসান।