করোনার ধাক্কা কাটিয়ে ঘুরে দাড়াচ্ছে নরসিংদীর দেশিয় বস্ত্রশিল্প

১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৩:৫০ পিএম | আপডেট: ২৮ মার্চ ২০২৪, ০৩:৫৮ এএম


করোনার ধাক্কা কাটিয়ে ঘুরে দাড়াচ্ছে নরসিংদীর দেশিয় বস্ত্রশিল্প

আসাদুজ্জামান রিপন:
নরসিংদীতে করোনা দুর্যোগের ধাক্কা কাটিয়ে ঘুরে দাড়াতে শুরু করেছে দেশিয় বস্ত্রশিল্পগুলো। করোনা পরিস্থিতিতে লকডাউন ও অর্থনৈতিক মন্দাভাবের ফলে বন্ধ হয়ে যাওয়া বস্ত্রশিল্পগুলোতে উৎপাদন শুরু হওয়ায় ফিরেছে কর্মচাঞ্চল্য।

এছাড়া দেশের বাইরে থেকে অবৈধ পথে কাপড় আমদানি বন্ধ থাকায় দেশিয় তৈরি সব ধরণের বস্ত্রের চাহিদা বেড়েছে। তবে সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা হলেও এই জেলার টেক্সটাইল, ডাইংসহ দেশিয় বস্ত্রশিল্পের সাথে সম্পৃক্ত অন্যান্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলো এই সুবিধার আওতায় আসেনি বলে অস্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা।

সরেজমিন ঘুরে শিল্পমালিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দেশের অন্যতম বস্ত্রশিল্প সমৃদ্ধ নরসিংদী জেলায় রয়েছে ছোট বড় ৫ হাজার বস্ত্রকারখানা। ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে দেশের অভ্যন্তরীণ কাপড়ের চাহিদার প্রায় ৭০ ভাগ পূরণ করে থাকে নরসিংদীর বস্ত্রশিল্পগুলো। এখানকার বেশিরভাগ বস্ত্র ব্যবসায়ী বংশপরম্পরায় কাপড় উৎপাদনে জড়িত। দেশের অন্যতম পাইকারী কাপড়ের হাট প্রাচ্যের ম্যানচেস্টার খ্যাত শেখের চর বাবুরহাটের অবস্থানও এই জেলায়।
এক সময় প্রায় প্রত্যেক গ্রামেই হস্তচালিত তাঁতের মাধ্যমে বুনা হতো শাড়ী, লুঙ্গি, গামছা, বিছানা চাদর। কালের বিবর্তনে হস্তচালিত তাঁতকল বিলুপ্ত হতে শুরু করে। এখন এ জেলায় উন্নত প্রযুক্তির যন্ত্রচালিত তাঁতে তৈরি হচ্ছে থ্রি-পিস, শার্টপিস, শাড়ী, লুঙ্গি, গামছা, বিছানা চাদরসহ অন্যান্যসব দেশীয় কাপড়।



করোনা পরিস্থিতির শুরুতে বন্ধ হয়ে পড়ার পর সরকারি সিদ্ধান্তে সীমিত পরিসরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চালু করা হয় নরসিংদীর বস্ত্রকারখানাগুলো। জুন মাসের শুরু থেকে আংশিক বস্ত্রশিল্পে শুরু হয় উৎপাদন। পর্যায়ক্রমে দেশীয় কাপড়ের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় গত দুইমাসে (জুলাই ও আগস্ট) উৎপাদনে ফিরেছে জেলার প্রায় ৮০ ভাগ বস্ত্রশিল্প। সারা বছরজুড়ে অবাধে অবৈধ পথে ভারত, পাকিস্তান ও চায়নাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি হতো দেশির চাহিদার অনেক কাপড়। এতে প্রতিযোগিতার মুখে পড়ে লোকসানে পড়তে হচ্ছিল দেশিয় বস্ত্রশিল্পগুলোকে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে দেশের বাইরে থেকে অবাধে অবৈধ পথে কাপড় আমদানি না হওয়ায় চাহিদা বেড়েছে দেশিয় তৈরি সবধরণের বস্ত্রের। “প্রাচ্যের ম্যানচেষ্টার” বলে খ্যাত শেখের চর-বাবুরহাটেও জমে উঠেছে দেশিয় তৈরি সবধরণের কাপড়ের বেচাকেনা। এতে করোনার ধাক্কা কাটিয়ে জেলার সব বস্ত্রকারখানায় পুরোদমে উৎপাদন শুরু করা যাবে বলে আশাবাদী শিল্পমালিকরা।  

তবে বস্ত্রশিল্প মালিকরা জানান, সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা হলেও নরসিংদী জেলার টেক্সটাইল, ডাইংসহ দেশিয় বস্ত্রশিল্পের সাথে সম্পৃক্ত অন্যান্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলো এই সুবিধার আওতায় আসেনি। এছাড়া ব্যাংকগুলোর স্থানীয় শাখা কর্তৃপক্ষের অনাগ্রহ ও অসহযোগিতার কারণে বিপাকে রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। দেশিয় বস্ত্রশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের আওতায় সরকারের প্রণোদনার দাবি জানান ব্যবসায়ীরা।



নরসিংদীর মোল্লা স্পিনিং মিলস এর পরিচালক রাশিদুল হাসান রিন্টু বলেন, টেক্সটাইল, ডাইং, প্রিন্টিং, ফিনিশিং, উইভিংসহ দেশিয় বস্ত্রশিল্পের সাথে সম্পৃক্ত বিভিন্ন পর্যায়ের ছোটবড় কারখানায় কর্মচাঞ্চল্য ফিরেছে। করোনা মোকাবেলার পাশাপাশি বেশিরভাগ কারখানায় উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সুতার চাহিদাও বেড়েছে।    

নরসিংদী ডাইং এন্ড প্রিন্টিং এসোসিয়েশন এর সভাপতি আফতাব উদ্দিন ভুইয়া বলেন, করোনায় উৎপাদন বন্ধ থাকায় থ্রিপিস, থান, প্রিন্টিং, পপলিন, ভয়েল কাপড়সহ দেশিয় বস্ত্রের চাহিদা হঠাৎ করে বেড়ে গেছে। সরকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করায় বৃহত্তর শিল্পগুলো তা পেলেও এই জেলার টেক্সটাইল, ডাইংসহ দেশিয় বস্ত্রশিল্পের সাথে সম্পৃক্ত অন্যান্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলোতে এই প্রণোদনা সুবিধা পৌঁছেনি। ৭০ ভাগ কাপড়ের চাহিদার যোগানদাতা দেশিয় বস্ত্রকারখানাগুলোকে প্রণোদনার আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি।

নরসিংদী চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ড্রাষ্ট্রিজ এর প্রেসিডেন্ট আলী হোসেন শিশির বলেন, দেশিয় বস্ত্রশিল্পের প্রায় ৬০ ভাগ চালু হয়েছে বাকিটা চালু হতে আরও সময় লাগবে। স্থানীয় ব্যাংকগুলোর কিছুটা অনাগ্রহী মনোভাব, শিল্পমালিকদেরও অনেকের কাগজপত্র সমস্যা থাকাসহ বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে এসব শিল্পের প্রণোদনা প্রাপ্তিটা সন্তোষজনক নয়।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস এসোসিয়েশন (বিটিএমএ) এর সহ সভাপতি ও নরসিংদী চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ড্রাষ্ট্রিজ এর সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, করোনার কারণে দীর্ঘদিন ধরেই বস্ত্রশিল্পগুলো ক্রান্তিকাল অতিক্রম  করেছে। এখন করোনার ধাক্কা কাটিয়ে ঘুরে দাড়ানোর চেষ্টা চলছে। এই সময়ের একটি ইতিবাচক দিক হচ্ছে লকডাউনের কারণে অবৈধ পথে দেশের বাইরে থেকে কাপড় আমদানি বন্ধ থাকায় দেশিয় তৈরি কাপড়ের চাহিদা বেড়েছে। করোনা পরবর্তী সময়ে যেন এসব কাপড় আমদানি না হয় সেদিকে সরকারে দৃষ্টি কামনা করছি।
তিনি বলেন, এরমধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এই প্যাকেজটি যদি সুষ্ঠুভাবে বিতরণ হয় এবং প্রান্তিক পর্যায়ের বস্ত্রশিল্প মালিকরা পায়, তাহলে আবার শিল্পসমৃদ্ধ নরসিংদী জেলা অবশ্যই ঘুরে দাড়াবে।



এই বিভাগের আরও