সাফল্যের মন্ত্র একাগ্রতা

২০ ডিসেম্বর ২০১৭, ০৭:১৫ এএম | আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৫৯ পিএম


সাফল্যের মন্ত্র একাগ্রতা
ফাহিম ইবনে সারওয়ার ছোটবেলায় দেখতাম বোর্ডস্ট্যান্ড করা ছেলেমেয়েদের ছবি পত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপা হচ্ছে। স্কুলে কেউ বোর্ড স্ট্যান্ড করলে মানুষজন দেখতে আসতো। আমাদের স্কুলে একজন বড় ভাই স্ট্যান্ড করেছিলেন মনে আছে, ১৮ তম হয়েছিলেন যশোর বোর্ডে। তাকে নিয়ে স্কুলজুড়ে সে কি মাতামাতি। আমার সাত বছরের স্কুলে জীবনে আর কাউকে পাইনি বোর্ডস্ট্যান্ড করা। পরে বরিশাল বোর্ড হল, গ্রেডিং সিস্টেম আসলো। জিপিএ-৫ এত বাড়লো যে এখন আর আলাদা করে কারো ছবি ছাপা হয় না। সেই ক্রেজটা এখন এসে পড়েছে বিসিএস এর উপর। ক্যাডার হওয়া অনেকটা বোর্ড স্ট্যান্ড করার মতই হয়ে গেছে। পাড়ায়-মহল্লায়, ভার্সিটির হলে হলে খবর ছড়িয়ে পড়ে! কারণ? প্রতিযোগিতা। দুই/তিন লাখ পরীক্ষা দেয়, ক্যাডার হয় দুই হাজার। এর মধ্যে কোটা আছে, প্রফেশনাল আছে। সব বাদ দিয়ে জেনারেল ক্যাডারে চান্স পায় ২০০ থেকে ৩০০ জন। কোটা বা প্রফেশনাল ক্যাডার ছাড়া যারা ক্যাডার পান তাদের যে কি পরিশ্রম করতে হয় তার কিছুটা নমুনা দেখেছিলাম আমাদের ডিপার্টমেন্টের এক বড় ভাইয়ের লেখাপড়া দেখে। সেই ভাই এখন এএসপি, আগে ছিলেন ব্যাংকার। এএসপি হওয়ার আগে তার আরো সুযোগ হয়েছিল ঢাকা ভার্সিটির আইবিএ থেকে এমবিএ করার, বাংলাদেশ ব্যাংকের এডি হওয়ার। এতসব অপশনের মধ্যে থেকে তিনি বিসিএস ক্যাডারকেই বেছে নেন। আমাদের সেই ভাই প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার পড়ার ব্যপারে যেভাবে ডেডিকেটেড ছিলেন তাতে তার যে বিসিএস হবে আমরা সবাই নিশ্চিত ছিলাম। আমাদের এক বন্ধু বলেছিল, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য যদি কোন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা থাকতো তাহলে আমাদের ভাই পরীক্ষা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়ে যেতেন’। এরকম নিশ্চিত আমরা আরো কয়েকজন বড় ভাই, আপু এবং বন্ধু বান্ধবীদের ক্ষেত্রেও ছিলাম। তারা সবাই বিসিএস ক্যাডার হয়েছে। এই ডেডিকেশনটা আসলো কোত্থেকে? এসেছে প্যাশন থেকে। তারা সবাই বিসিএস ক্যাডার হতে চেয়েছে কারণ সেটা তাদের স্বপ্ন ছিল। তাদের মনে হয়েছে এটাই তারা সবচেয়ে ভালোভাবে করতে পারবে। এখানেই তারা তাদের মেধার সর্বোচ্চটা দিতে পারবে। নাহলে প্রাইভেট ব্যাংকের যে স্যালারি স্কেল সেই তুলনায় বিসিএস ক্যাডারের স্যালারি স্কেল কমই ছিল। তারপরও কেন বিসিএস এর জন্য নাওয়া খাওয়া ছেড়ে পড়লেন? কারণ তার প্যাশন ছিল বিসিএস। এরকম অসংখ্য উদাহরণ আছে। আমাদের এক বন্ধু আমাদের ডিপার্টমেন্টে শিক্ষক হিসেবে জয়েন করেছিল। পরে ফরেন ক্যাডারে জয়েন করেছে। আবার আমাদেরই এক বড় ভাই আমাদের ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক হিসেবে জয়েন করেছিলেন। তারও বিসিএস হয়েছিল, পুলিশ ক্যাডারে কিন্তু তিনি যাননি। তার প্যাশন ছিল হয় ফরেন ক্যাডার নয় শিক্ষকতা। তিনি শিক্ষকতাতেই রয়ে গেছেন। মূল কথাটা বিসিএস না মূল কথাটা হল প্যাশন।সবাই বিসিএস দিচ্ছে বলেই দিতে হবে,তাহলে হবে কীভাবে? একটা জেনারেশনের সবাই তো বিসিএস ক্যাডার হবে না। আমাদের ক্লাসে আমরা ৪৫ জনের মত ছিলাম। বিসিএস ক্যাডার হয়েছে ৪/৫ জন। বাকিরা কেউ ব্যাংকার, সাংবাদিক, কর্পোরেট, এনজিও, শিক্ষকতা, লেখালেখিতে চলে গেছে।যার যেটা প্যাশন সে সেটাই করছে। আমাদের ক্লাসের যে বন্ধুটি ‘সিক্স ডিজিট’ স্যালারি দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেছে সে বিসিএস ক্যাডার না। সে আন্তর্জাতিক সংস্থার একজন কর্মকর্তা। আমাদের মাস্টার্স পরীক্ষা যেদিন শেষ হয় তার এক সপ্তাহের মধ্যেই সে মাস্টার্স করতে জার্মানি চলে গিয়েছিল। ওর প্যাশন ছিল বাইরে লেখাপড়া করার। ও ওর লক্ষ্যপূরণে এগিয়ে গেছে। আজ দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমাদের যে বন্ধুটা গবেষক হতে চেয়েছিল সে কিন্তু বিসিএস দেয়নি। কিন্তু চেষ্টা করলে তারও হতো। তার ইচ্ছা হয়নি, সে গবেষণাতেই আছে। কারণ ওদের কারোরই মনে হয়নি বিসিএস দিলেই ওরা ওদের মেধার সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে পারবে। আবার আমাদেরই ক্লাসের এক বন্ধু, এক বান্ধবী ওরা অন্য কোন চাকরিতে জয়েন করেনি। ওদের প্যাশন ছিল বিসিএস। ওরা বিসিএস এর জন্যই তিন/চার বছর ধরে শ্রম দিয়ে গেছে এবং সরকারি চাকরি দিয়েই ক্যারিয়ার শুরু করেছে, বিসিএস ক্যাডারও হয়েছে। আবার অনেকের কাছেই গল্প শুনি ক্যাডারে কেমন বৈষম্য হয়। ক্যাডারে চাকরি করেও অনেকে সুখী না। সারাজীবন ঢাকায় থেকেছে এখন থাকতে হচ্ছে মফস্বলে। আবার ক্যাডার পেয়ে ঢাকা ছাড়তে পারায় অনেকে খুশি। আনন্দের সাথে কাজ করে যাচ্ছে। এরকম অনেক ঘটনা আছে। বিসিএস নিয়ে প্যাশনেট অনেকেই ক্যাডার হতে পারেনি। তাদের আফসোস আছে। সরকারি চাকরি করছে কিন্তু ক্যাডার না পাওয়ায় যে হতাশা সেটা রয়ে গেছে, আরো অনেকদিন হয়তো সেটা বয়ে বেড়াবে তারা। রাজকুমার হিরানি তাঁর ‘থ্রি ইডিয়টস’ ছবিতে এই জিনিসটাই দেখিয়েছেন। নিজের প্যাশনের পিছনে ছুটতে হবে। জীবন একটাই সেটা অন্য কারো স্বপ্ন পূরণের জন্য খরচ না করে নিজের জন্য খরচ করতে হবে। হিরানি তাঁর প্রথম ছবি ‘মুন্নাভাই এমবিবিএস’ বানিয়েছিলেন ৪১ বছর বয়সে! সিনেমার জন্য তাঁর প্যাশনটা বুঝতে পারছেন? সব কথার শেষ কথা আবার সেই প্যাশন, ইচ্ছা, আগ্রহ। আমি এটাই করতে চাই। দুনিয়া এদিক ওদিক হয়ে গেলেও আমি এটাই করবো, এই জেদ যার মধ্যে থাকবে সে তার মেধা, শ্রম দিয়ে নিজের জায়গা করে নেবে।


এই বিভাগের আরও