কোটা সংস্কারের পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা

০৬ মার্চ ২০১৮, ১১:০৯ এএম | আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৪৫ পিএম


কোটা সংস্কারের পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা
অনলাইন ডেস্ক [caption id="attachment_1882" align="alignnone" width="1200"] ছবিঃসংগৃহীত[/caption] সরকারি চাকরির নিয়োগে ৫৬ শতাংশ বিদ্যমান কোটা পদ্ধতিকে বৈষম্য বলছেন সাধারণ প্রার্থীরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে রাজপথ সবখানেই কোটা সংস্কারের ৫ দফা দাবি আলোচনার কেন্দ্রে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচির হুঁশিয়ারি প্রার্থীদের। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা বলছেন মেধার মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতির সংস্কার আবশ্যক। স্বাধীনতার এত বছর পর মুক্তিযোদ্ধা কোটা থাকা উচিত নয়- অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের এমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এটা পরিষ্কারভাবে অগ্রহণযোগ্য। আমলারা দেশ চালাতে বড় ভূমিকা রাখেন। সেখানে যদি কোটার সাহায্যে মেধাবীরা না গিয়ে কম মেধাবীরা যায় তাহলে গোটা ব্যবস্থাই দুর্বল হয়ে যায়। অন্যদিকে যারা মেধাবী ছাত্র, যারা পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পাবে বলে আশা করেন তাদের মধ্যে একটা হতাশা তৈরি হচ্ছে। অথচ কোটার মাধ্যমে কম মেধাবীরা ভালো জায়গায় চলে যাচ্ছে। আর দেশের পশ্চাদপদ এলাকা যেমন, পাহাড়ি এবং ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জন্য কোটা থাকুক কিন্তু এরপরে অন্য কোনো বিষয়ে কোটা থাকা উচিত বলে আমি মনে করি না। মুক্তিযোদ্ধা কোটা এক সময় ছিল সেটা ঠিক আছে। কিন্তু স্বাধীনতার এতদিন পরে এখন আর এই কোটা থাকা উচিত না। এখন মেধার ভিত্তিতে নেয়া উচিত। মেয়েরাও এখন অনেক এগিয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করছে। তাই এখন নারীদের সংরক্ষিত কোটারও দরকার নেই। ২২ শতাংশ কোটা রেখে ৭৮ শতাংশ মেধায় নিয়োগ দেয়া হোক- অধ্যাপক ড. এএসএম আমানুল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এএসএম আমানুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা এটা অযৌক্তিক। নারীদের উন্নতি হয়েছে। তবে এখনও ওই পর্যায়ে পৌঁছায়নি, যে পর্যায়ে পৌঁছলে নারী কোটা তুলে দেয়া যায়। তাই নারীদের জন্য বর্তমানে ৫ শতাংশ কোটা রাখা যেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে সময় নির্ধারণ করে দেয়া দরকার যে, আগামী কত বছর এ কোটা থাকবে, ১০ বছর নাকি তারও বেশি। মুক্তিযোদ্ধা কোটা ১০ শতাংশ রাখা যায় এবং নিয়ম করে দিতে হবে একটা পরিবার থেকে একবার এ সুবিধা নিতে পারবে। নাতি-পুতি, চৌদ্দগোষ্ঠী এ সুবিধা পাবে না, একবার পাবে। ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীরা এখনও পিছিয়ে তাই তাদের ৩ শতাংশ দেয়া যেতে পারে। নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, গাইবান্ধার মতো আরও কিছু জেলা এখনও পিছিয়ে আছে, এগুলোর জন্য ২ শতাংশ জেলা কোটা রাখা যেতে পারে। আর প্রতিবন্ধীরা আমাদের সমাজেরই অংশ। তারা যদি লিখিত পরীক্ষায় পাস করে আসতে পারে তবে ২ শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা রাখা যেতে পারে। এ মোট ২২ শতাংশ কোটা দিয়ে বাকি ৭৮ শতাংশ যদি মেধায় নিয়োগ দেয়া হয়, তাহলে সমস্যাটা আপাতত সমাধান হবে। কোটাকে ৫০ শতাংশের নিচে কমিয়ে আনা উচিত- মেসবাহ কামাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল যুগান্তরকে বলেন, সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে সমপর্যায়ে আনার জন্য কোটা প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশে কোটা ব্যবস্থায় নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে। বিশেষত মেধা তালিকার তুলনায় কোটার পরিমাণ বেশি হওয়ায় এবং কোটার জন্য বরাদ্দকৃত পদ পূরণ না হওয়ায় সেই পদগুলো শূন্য থাকছে। ফলে জটিলতা আরও বেড়েছে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিত বেকার তৈরি হচ্ছে। দীর্ঘকাল যাবৎ তাদের কর্মসংস্থানের ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ফলে বেকারত্বের হার বাড়ছে এবং মূল সেই সমস্যার দিকে নজর না দিলে চাকরি প্রার্থীদের ক্ষোভ আরও বাড়বে। কাজেই কোটা পদ্ধতির সংস্কার প্রয়োজন। কোটাকে ৫০ শতাংশের ওপরে কোনোভাবেই নয়, পারলে আরও কমিয়ে আনা উচিত। বর্তমানে জেলা কোটা তুলে দেয়া উচিত কিন্তু গবেষণায় কতগুলো উপজেলা পশ্চাদপদ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তাই ১০% জেলা কোটা তুলে এ উপজেলাগুলোর জন্য ২% কোটা রাখা যেতে পারে। এমনভাবে সংস্কারের আরও জায়গা আছে। মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ সব কোটার সুবিধা কারা পাবে তার একটা নিয়ম করে দেয়া উচিত। যারা আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি তাদের পরিবারকে এ সুবিধা দেয়া উচিত নয়। আর কোনো কোটাই এক পরিবারের ক্ষেত্রে একবার সর্বোচ্চ দুই বারের বেশি পাওয়া উচিত নয়। বংশ পরম্পরায় মুক্তিযোদ্ধা কোটা বন্ধ করা উচিত- সৌমিত্র শেখর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর বলেন, কোটা থাকার প্রয়োজন আছে। তাই কোটা থাকবে কিন্তু এর পরিমাণ কমিয়ে আনা যেতে পারে। মুক্তিযোদ্ধা কোটা নাতি-নাতনি বংশ পরম্পরা পর্যন্ত চলবে কিনা এটা নিয়ে জোড় ভাবনার প্রয়োজন আছে। আমি মনে করি সর্বোচ্চ মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান পর্যন্ত এটা থাকতে পারে। সরাসরি সন্তানের পর এটি বন্ধ করে দেয়া উচিত। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হলেই যে স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তি হবে তা নয়। আমার ব্যক্তিগত একটা অভিজ্ঞতা হল, একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পরীক্ষাতে অংশ নিতে গেছিলাম। আমার সঙ্গে যিনি প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন তিনি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কিন্তু করেন ছাত্র শিবির। এখন ছাত্র শিবিরের এ সন্তান মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি দাবি করে বসেছেন! কাজেই এ রকম সংকট যে নেই তা কিন্তু নয়। মুক্তিযোদ্ধা সন্তানের সুযোগ নিয়ে অনেক স্বাধীনতাবিরোধীও চাকরিতে যেতে পারে। কোটার পরিমাণ বেশি হলে এদের প্রবেশ করার সুযোগ বেড়ে যায়। তাই কোটার পরিমাণ নিয়ে চিন্তার দরকার আছে এবং মেধার পরিমাণ বাড়ানো উচিত। বৈষম্য দূর করতে গিয়ে নতুন বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে- তানিয়া হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন্স অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তানিয়া হক যুগান্তরকে বলেন, রাজনৈতিকভাবে নারীর অবস্থান দুর্বল। তাই ‘ন্যায়ের ভিত্তিতে সমতা’ নিশ্চিত করার একটা প্রকৃত মাধ্যম হচ্ছে কোটা সিস্টেম। এ জন্য জাতীয় সংসদেও নারীদের জন্য কোটা রাখা হয়েছে। কিন্তু এ কোটায় খুব বেশি লাভ হচ্ছে না। কারণ সেখানে পছন্দের ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। যদি ওই সংরক্ষিত আসনে নারীরা জনগণের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হতো তবে এর কার্যকারিতা বড়ত। আর পূর্বের থেকে নারীদের অবস্থানের কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তাই চাকরি ক্ষেত্রে কোটার প্রশ্নে আলোচনা হতে পারে। সামগ্রিকভাবে অগ্রাধিকার কোটায় ৫৬% আর মেধায় ৪৪%। এর ফলে মনে হচ্ছে বৈষম্য দূর করতে গিয়ে এখন যেন নতুন বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে। ৩ মাসের মধ্যেই কোটা সংস্কার করা সম্ভব---আবুল কাশেম ফজলুল হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেন, সরকার যদি চায় আগামী ৩ মাসের মধ্যেই কোটা সংস্কার করা সম্ভব। এতে কোন জটিলতা নেই। আমি মনে করি কোটা সংস্কার করা উচিত। এতে যদি সংবিধানও সংস্কার করতে হয় তা করতে হবে। তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের এখন আর একজনরেও নতুন করে দরখাস্ত করার সুযোগ নেই কিন্তু তাদেরটাও বাতিল করে নাই। মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরাও বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে। কোটা সন্তান পর্যন্ত থাকতে পারে। নাতিপুতিরা ভোগ করবে এটা উচিত নয়। একটা সময় যেয়ে এটা বন্ধ করা উচিত। সেটা এখনও হতে পারে এবং ৫ বছরের মধ্যেও হতে পারে। তবে দীর্ঘ সময় নেয়া উচিত। তিনি আরও বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ভাবে সহায়তা দেয়া হচ্ছে। আর্থিকসহ বিভিন্ন সুবিধা পাচ্ছে। এটাকে যুক্তিসংগত মনে করি। কোটা সংস্কার দাবি করায় এদের রাজাকার বলা একটা নির্লজ্জ কথা ও মিথ্যাচার। একজন কোটার বিরুদ্ধে কথা বলতেই পারে। তাই বলে তাকে রাজাকার বলে দেওয়া অন্যায়। আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেন, সরকার যদি চায় আগামী ৩ মাসের মধ্যেই কোটা সংস্কার করা সম্ভব। এতে কোন জটিলতা নেই। আমি মনে করি কোটা সংস্কার করা উচিত। এতে যদি সংবিধানও সংস্কার করতে হয় তা করতে হবে। ''নাতিপুতি কোটা অনির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত থাকা উচিত নয়। আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের অবশ্যই সম্মান করি। সেইজন্য সন্তানরা কোটা পাক তার পক্ষে। কিন্তু নাতিপুতি কোটা মোটেও থাকা উচিত নয়।'' এই বুদ্ধিজীবী বলেন, আদিবাসী কোটাও ৫% থেকে ২% পর্যন্ত এ নামিয়ে আনা উচিত।মেধা কোটা না বলে যোগ্যতা ভিত্তিক বলা উচিত। বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থা অযৌক্তিক, অনৈতিক---মুজিবর রহমান এসোসিয়েট প্রোফেসর মোহাম্মদ মুজিবর রহমান বলেন, বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থা অযৌক্তিক, অনৈতিক, অমানবিক ও হৃদয়বিদারক।আমরা হয়তো সিরিয়া, ইয়েমেন, মিয়ানমার কিংবা ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান করতে পারবোনা; কিন্তু আমরা চাইলেই কোটা ব্যবস্থার একটা যৌক্তিক সংস্কার করতে পারি।এবং এটা সময়ের দাবী। সরকারি চাকরিতে এখন কোটার যে অবস্থা তা ন্যায় নীতির পরিপন্থী---সাইফুদ্দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে এখন কোটার যে অবস্থা তা ন্যায় নীতির পরিপন্থী৷ কারণ মেধার চেয়ে সংরক্ষিত কোটা বেশি হতে পারেনা৷ বাংলাদেশের সংবিধানে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সমতা নীতির কথা বলা হয়েছে৷ তবে সংবিধানে এও বলা হয়েছে অনগ্রসর সম্প্রদায়কে অগ্রসর করতে কোনো বিধান করতে সরকারকে ওই(সমতা) বিধান বাধাগ্রস্ত করবেনা৷ তবে প্রশ্ন হল মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযোদ্ধা বলেই কি অনগ্রসর? আর আরো যারা অনগ্রসর কোটা সুবিধা পাচ্ছেনা তারা এখনো অনগ্রসর আছেন কিনা৷'' তিনি বলেন, ‘‘সরকারি চাকরিতে কোটার বিষয়টি এখন নতুন করে পর্যালোচনা করা দরকার৷ এটার সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে৷ কোনোভাবেই কোটা শতকরা ৫০ ভাগের বেশি হওয়া উচিত না৷ আর যখন ১৯টি জেলা ছিল তখন সেখানে কোটা বিন্যাস করা সম্ভব ছিল৷ এখন ৬৪ জেলায় কোটা বিন্যাস অবাস্তব৷''