ভুল তো আমার ও ছিল !!

১৬ জানুয়ারি ২০১৮, ০৩:২২ এএম | আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১২:১৫ পিএম


ভুল তো আমার ও ছিল !!
অনলাইন ডেস্ক [caption id="attachment_1318" align="alignnone" width="1024"] ছবিঃ সংগৃহীত[/caption] স্কুলজীবন থেকে তিনজন বন্ধু। একজন একটু সংবেদনশীল। নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস কম। একটু কটূক্তি শুনলেই ভেঙে পড়ে। বাকি দুজন এই দুর্বলতা বুঝতে পেরেও তাকে উঠতে-বসতে ছোট করতে থাকে। এই চাপে পড়ে সেই বন্ধু একসময় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সে গিয়ে বাকি দুজনকে বলে তার কষ্টের কথা। সেই দুজন কথার তো দামই দেয় না, বরং মানসিক অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এটা যে তারা খুব বুঝেশুনে করে তা না। স্কুলজীবনে সবাই কমবেশি অসংবেদনশীল হয়। এই অত্যাচার সেনসিটিভ ছেলের মনের ওপর ভয়ংকর দাগ কাটে। স্কুল ছেড়ে কলেজ, তারপর বিশ্ববিদ্যালয়, তারপর চাকরিজীবন। তিনজনের বন্ধুত্ব টিকে যায়। বয়সের সঙ্গে মানুষের মানবিকবোধ বৃদ্ধি পায়। মানুষ মানুষকে বুঝতে শেখে। সে কারণেই হয়তো দুই বন্ধু আস্তে আস্তে আঁচ করতে পারে যে স্কুলজীবনের মানসিক অত্যাচারের কষ্ট তৃতীয় বন্ধু কাটিয়ে উঠতে পারেনি। একদিন তারা বন্ধুর সঙ্গে গিয়ে এ নিয়ে কথা বলে। তারা যে অনুতপ্ত সে কথা জানায়। আস্তে আস্তে সংবেদনশীল বন্ধুর দুঃখ কেটে যায়। তার চেয়েও আশ্চর্যজনক বাকি দুই বন্ধু নিজেদের ব্যাপারে অনেক হালকা বোধ করে। কিছু কিছু বিষয়ে আমূল পরিবর্তন আসে তাদের মাঝে। মানুষ হিসেবে তারা আরও অনেক বেশি সহনশীল হয়ে ওঠে। নিজেদের ভুল স্বীকার মনে শান্তি দেয়। এ ঘটনা বাস্তবে আমার দেখা। আরেকটা ঘটনা বলি। এক বাবা আর তাঁর ছেলের গল্প। ছেলের ছোটবেলায় তাঁদের মধ্যে মধুর সম্পর্ক। একসঙ্গে খেলাধুলা করে, ঘুরে বেড়ায়, গল্প করে। তারপর ছেলে একটু বড় হয়। বড় হওয়ার ব্যাপারে সব বাবা-ছেলের মধ্যে হয়তো কিছু প্রজন্মগত পার্থক্য থাকে। এটা বাবা মেনে নিতে পারেন না। বিভিন্ন বিষয়ে ছেলের খুঁত ধরতে শুরু করেন তিনি। ছেলে যখন সাবালকত্ব ছুঁতে শুরু করে, তখন বাবার মনে হতে থাকে যে ছেলে একদমই ঠিকঠাক মতো বড় হতে পারেনি। ছেলেরও মনে হয় যে তার বাবা তাকে একদমই সহ্য করতে পারেন না। বয়সের সঙ্গে ক্রমশই তাঁদের দূরত্ব বাড়তে থাকে। আপাতদৃষ্টিতে তাঁদের মধ্যে হৃদ্যতা আছে মনে হলেও মনের ভেতর বহু মাইলের ফারাক তৈরি হয়। এতে বাবাও কষ্ট পান, ছেলের জীবনও এক দুর্বিষহ সময়ের মধ্য দিয়ে যায়। কোনো কিছুতেই ছেলের মনে হয় না যে সে ঠিক কাজটা করছে। সারাক্ষণ বাবাকে নিরাশ করার আতঙ্কের মধ্যে থাকে। এতে তার কর্মক্ষেত্র এবং ব্যক্তিগত জীবন দুটোতেই ব্যাঘাত ঘটে। একদিন তার ছোট ভাই বাবাকে গিয়ে এ কথা বলে। প্রথমে ছেলের মানসিক অশান্তির পেছনে নিজের দায়িত্ব না মেনে নিলেও বাবা আস্তে আস্তে তাঁর ভূমিকা উপলব্ধি করা শুরু করেন। বড় ছেলের সঙ্গে কথা বলেন। একদিনে হয়তো তাঁদের সম্পর্ক ঠিক হয় না, কিন্তু একটু একটু করে ঠিক হতে থাকে। ছেলের আত্মবিশ্বাস বাড়ে। বাবা-ছেলের মধ্যে মানসিক দূরত্ব কমে আসে। বাবা শেষ বয়সে এসে একটি মধুর মানসিক শান্তি অনুভব করেন। এই বাবা-ছেলে আমার খুব কাছের। তাঁদের এখন দেখলে ভালো লাগে। মাঝে মাঝে কিঞ্চিৎ ঈর্ষাও হয়। আমরা আমাদের অজান্তে অনেক সময়ই মানুষকে কষ্ট দিয়ে থাকি। হয়তো অজান্তেই দিই। অনেক দিন ধরে দিই। নিজেরাই বুঝি না যে কাছের একজনকে সাংঘাতিকভাবে আমরা ব্যথা দিচ্ছি। কিন্তু যখন বুঝতে পারি, সেই উপলব্ধি যত দেরিতেই হোক না কেন, আমার মনে হয় যে আমাদের নিজেদের ভুল স্বীকার করে সেটা ঠিক করার চেষ্টা করা উচিত। এতে যে কষ্ট দিয়েছে, তারও শান্তি হয় এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যে কষ্ট পেয়েছে, তার একটু হলেও ভালো লাগে। ওপরের দুটি ঘটনার মতো আরও অনেক এ রকম ঘটনা আমার জানা আছে। তবে আমি কথাগুলো শুধু আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি না। আধুনিক মনোবিজ্ঞান আমার এই বিশ্বাসকে সমর্থন করে। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, আমরা যখন কোনো মানসিক বা শারীরিক চাপের মধ্যে থাকি, তখন আমাদের শরীরে করটিসল নামে একটি হরমোন তৈরি করে। এই হরমোনের প্রধান কাজ শরীর এবং মনকে কোনো কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সাহায্য করা। সেটা শারীরিক বা মানসিক দুটোই হতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে করটিসল মানুষের জন্য উপকারী। কিন্তু অহেতুক বেশি করটিসল যদি তৈরি হয়, তখন শরীর ও মন সারাক্ষণ মনে করতে থাকে, যে তারা আক্রমণের সম্মুখীন হয়ে আছে। এমতাবস্থায় শারীরিক এবং মানসিক সুস্থতায় ব্যাঘাত ঘটে। সুখ এবং শান্তি নষ্ট হয়। একজন খুব কাছের মানুষকে কষ্ট দিয়েছি—এই বিষয়টা যদি সারাক্ষণ আমাদের মাথায় ঘুরতে থাকে, তাহলে বাড়তি করটিসল তৈরি হতে বাধ্য। মানসিক এবং শারীরিক ব্যাঘাত হতে বাধ্য। বিষয়টাকে সরাসরি মোকাবিলা করাই সুস্থ জীবন যাপন করার সবচেয়ে কার্যকরী উপায়। এ কারণেই টুয়েলভ স্টেপ প্রোগ্রাম থেকে শুরু করে ইন্টিগ্রেটেড কগনিটিভ বিহেভিরিয়াল থেরাপির সব মানসিক সুস্থতা বৃদ্ধির তত্ত্বই বলে যে পুরোনো কোনো ভুল বা অনুশোচনাকে যথাসাধ্য মোকাবিলা করতে হবে। আমি এই বিজ্ঞানে বিশ্বাস করি। আর তত্ত্বের বাইরে এলে একজন মানুষ হিসেবে মনে করি যে কাউকে কষ্ট দিলে সেটা সব সময়ই ভুল স্বীকার করা উচিত। যত দেরি করেই হোক না কেন। সেটাই সুস্থ, সেটাই শান্তিময়। আগের ভুলগুলোর সমাধান করার চেষ্টা করি। আগামীকে আরও শান্তির সঙ্গে আলিঙ্গন করি। নতুন বছরে এই আমার নিজের এবং আপনাদের প্রতি কামনা।


এই বিভাগের আরও