জীবনানন্দ দাশের একজন ভক্ত

১৪ ডিসেম্বর ২০১৭, ০৭:২৭ এএম | আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:৪৯ এএম


জীবনানন্দ দাশের একজন ভক্ত
ফাহিম ইবনে সারওয়ার

এই শহরের একমাত্র সাইকায়াট্রিস্ট নেহাল আফতাব। ছোট মফস্বলে মানুষ মানসিক সমস্যাকে তেমন একটা সমস্যা মনে করে না। মানসিক রোগ মানেই পাগল, পাবলিকের সহজ হিসাব। নেহাল সাহেবও যে খুব মানুষের উপকার করতে বা মানব সেবার ধর্ম নিয়ে এই শহরে পড়ে রয়েছেন তেমনটা নয়। বিয়ে করেননি। বয়স ৪০ চলছে।  পড়–য়া মানুষ। সারাক্ষণ বই নিয়ে পড়ে থাকতে ভালোবাসেন। বাপ-দাদার সম্পত্তি রয়েছে এই শহরেই প্রচুর। সেগুলো থেকে যে টাকা পয়সা আসে তা দিয়ে তার একার ভালোই চলে যান। সারাদিন বই পড়েন, সন্ধ্যার পড়ে চেম্বারে বসেন। রোগী তেমন একটা পান না। মজার বিষয় হচ্ছে রোগী হিসেবে যারা আসেন তারাও নিজেদের রোগী ভাবতে চান না। এমনভাবে কথা বলেন যেন ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন, আশেপাশে কিছু কাজ ছিল। সেটা করে ফিরে যাচ্ছিলেন। চেম্বার খোলা দেখে ঢুকে পড়েছেন।

নেহাল সাহেবের অবশ্য এসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই। সারাদিন বাসায় থাকেন বিকেলে একটু হাঁটতে বের হন। সেজন্যই চেম্বারটা নেয়া। যাতে হাঁটাহাঁটিটা হয়। তার নিজের বাড়ি খালিই পড়ে আছে। সেখানে করেননি কারণ তাহলে ঘর ছেড়ে আর বের হওয়া হবে না। বাসা থেকে চেম্বারে হেঁটে আসতে তার ১৫/২০ মিনিট সময় লাগে। চেম্বারে এসে নাস্তা করেন, রোগী থাকলে কথা বলেন।

শীতকালে অবশ্য চিত্র ভিন্ন। কোন এক আশ্চর্য কারণে শীতকালে ডা. নেহালের রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। শহরের সবাই নিজেকে পাগল ভাবতে শুরু করে। সবার মনের রোগগুলো যেন শীতকালে জেগে ওঠে এই বুড়ো শহরে। ডাক্তার সাহেব এমনিতেই মানুষের ভীড় বাট্টা তেমন একটা পছন্দ করেন না।  শীতকালটা তাই তার বেশ বিরক্ত লাগে। শীতকালে মানুষগুলো এমন পাগল হয়ে যায় কেন?

সেদিন এক মাঝবয়সী চাকরিজীবি অফিস সেড়ে সোজা ডাক্তার সাহেবের চেম্বারে হাজির। ডাক্তারকে বললেন, তার প্রায়ই ইচ্ছে করে স্ত্রীকে খুন করতে। তার সন্দেহ তার স্ত্রী পরকীয়ায় আসক্ত বহুদিন ধরে। কিন্তু হাতেনাতে ধরতে পারছেন না তাই খুন করতে পারছেন না। যেদিন ধরবেন সেদিনই খুন করবেন। ডাক্তারের কাছে অদ্ভূত এক পরামর্শ চাইলেন এই ভদ্রলোক,‘কীভাবে খুন করা যায় বলুন তো ডাক্তার সাহেব? বেশি কষ্টের মৃত্যু কোনটা হবে? এতদিন ধরে আমাকে পেইন দিল আমি কি এমনি এমনি ছেড়ে দিব?’

আরেকজন বুড়ো রোগী এসেছিলেন, শীতকালেই। গায়ে চাদর, পায়ে মুজো, মাথায় মাঙ্কি ক্যাপ। কোন জায়গা থেকে শীত ঢোকার কায়দা নেই। অথচ কি অদ্ভূত। সেই লোক বলে কিনা,‘ডাক্তার আমার খালি গরম লাগে। যতই জামা কাপড় পড়ি গরম কমে না।’

ডাক্তার সাহেব বললেন,‘জামা কাপড় পড়লে তো গরম লাগবেই। জামা কাপড় খুলে ফেলেন, ঠান্ডা লাগবে। তাছাড়া এখন তো শীতকাল, ঠান্ডা লাগার কথা।’

রোগী বলেন, ‘ওইটাই তো প্রবলেম ডাক্তার। আমার ব্রেইনের তার কাইটা গেছে। ফিলিংস চেঞ্জ হইয়া গেছে। শরীর এখন সিজন বুঝে না। শীতকালে গরম লাগে। গরম কালে শীত লাগে। কাপড় পড়লে ঠান্ডা লাগে। কাপড় খুললে গরম লাগে। আছি বড় ফাঁপড়ে। ওষুধ দাও!’

আরেক কিশোরী মেয়ে আসলো। বয়সের তুলনায় যার কথাবার্তার ওজন বেশি। এসেই বলে, ‘আমার এসএসসির রেজাল্ট হয়েছে পাঁচ মাস আগে। জিপিএ-৫, গোল্ডেন। আমার পেছনে পাঁচটা ছেলে ঘোরে। আমার মনে হচ্ছে আমি জীবনে অনেক বেশি সুখী। এই সুখই আমাকে পাগল করে তুলছে। আমার শুধু আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে। শীতকালে প্রতিদিন প্রতিটা সেকেন্ডে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা করে। শীতকাল আমার একদম ভালো লাগে না। দিস সিজন মেকস মি ফ্রাস্ট্রেটেড। আমার নিজেকের ভেরোনিকার মত মনে হয়। ভেরোনিকা ডিসাইডস টু ডাই। আই অলসো।’

শীতকালে প্রতিদিন এরকম রোগী দেখতে দেখতে এক সময় ডা. নেহাল আফতাবের মধ্যেও ফ্রাস্ট্রেশন ভর করে। তার বই পড়তে ভালো লাগে না। বিকেলে হাঁটতে ভালো লাগে না। চেম্বারে বসতে ভালো লাগে না। মানুষের অদ্ভূত, অবিশ্বাস্য সমস্যাগুলো শুনতে ইচ্ছা করে না। তার ইচ্ছে হয় মরে যেতে। এই সময় জীবনানন্দ দাশের কবিতা তার খুব ভালো লাগে। কবিতাগুলো তার মৃত্যু বিষয়ক ফ্যান্টাসিকে প্রবল করে।