ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছে (পর্ব- ১) :মাহিনুর জাহান নিপু

২৫ জুন ২০১৯, ০২:৩১ পিএম | আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:০৭ এএম


ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছে  (পর্ব- ১) :মাহিনুর জাহান নিপু
সেন্টমার্টিনে লেখিকা ও তার পরিবার

ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছে কার না হয়?কার না ইচ্ছে করে পাখির মতো উড়তে ঘুরতে মুক্ত বলাকার মতো।আমারো ছিল ছেলেবেলা থেকেই।স্কুল লাইফ থেকেই অনেক বেশি বই পড়ার অভ্যাস ছিল আমার। আর বই পড়তে পড়তে সেই জায়গাগুলো আমি চোখ বুজে কল্পনায় ঘুরে আসতাম।

আমি তখনই ভেবে রেখেছি জীবনে আল্লাহ যদি কখনো সুযোগ দেন আমি ভ্রমণ করবো দেশ আর বিদেশে। ধন সম্পদ শাড়ী গয়নার নেশা আমার ছিলনা কখনোই। আমার মনে হতো যত ঘুরবো পৃথিবীটা আমার কাছে তত ছোট হয়ে আসবে। আল্লাহর এত সুন্দর দুনিয়াটা না দেখেই মরে যাব? বিভিন্ন দেশ ও জাতির সংস্কৃতি ঐতিহ্য প্রকৃতি এসব দেখার আর জানার আগ্রহ আমার চিরদিনই ছিল। কিন্তু ভ্রমণ নিয়ে লেখালেখি করবো এটা কখনো ভাবিনি।

ভাবিনি একারণে যে লেখালেখি করাটা আমার কাছে ভীষণ কঠিন একটা কাজ মনে হতো। মনে হতো আমি যেভাবে দেখি বা ভাবি সেভাবে লিখে যেতে পারবো না। আমার বন্ধু মাহমুদা আঞ্জুমান আমাকে অনেক বলেছে লেখালেখি করতে।আজকের এই লেখা তার উৎসাহ পেয়েই।সে-ই আমাকে বলেছে প্রতিদিন যেন এক পৃস্টা করে হলেও লিখি।আমি জানিনা আমার এ লেখা কিছু হবে কি-না। যদি কিছু হয় তবে তারজন্য ধন্যবাদ পাবেন আল্লাহ।তারপর অঞ্জু। যার সাথে বিয়ে হয় আল্লাহর রহমতে সেও ভ্রমণ পাগল মানুষ। আর তাই সুবিধাটা হলো অনেক।

৷৷ পর্ব-- ১

তিনমাসের মেয়ে অদ্রিকে নিয়ে আমি জীবনে প্রথম খুলনা যাই বরের সরকারি চাকরির সুবাদে। সেটাই ছিল আমার প্রথম দূরে কোথাও যাওয়া। আর সময়টা ছিল সম্ভবত ২০০২ সাল।এত পরিচ্ছন্ন সুন্দর আর গোছানো কোন শহর হয় না দেখলে বিশ্বাসই হতোনা। আমি প্রেমে পরে গেলাম খুলনা শহরের। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই খুলনা ইউনিভার্সিটি, সুন্দরবন,রবীন্দ্রনাথের শ্বশুর বাড়ি, রুপসা,ফুলতলা, আমতলা ঘুরে বেড়াই। (শহরটা এখন আর আগের মতো নেই)।বাংলাদেশ ব্যাংক কোয়ার্টার এ ছিল আমাদের বসবাস। (তখন বর বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি করতো)। তাদের জীবন পদ্ধতি, রান্না-খাবার স্টাইল কিছুই আমাদের মতো না।সবকিছুই অন্যরকম লাগলো।ভাষাও বুঝতামনা। যদিও পরে মানিয়ে নিয়েছি।

৷৷ আমার মেয়ের বয়স তখন সবেমাত্র ১৩ মাস।বাংলাদেশ ব্যাংক কোয়ার্টার থেকে বরের কয়েকজন বন্ধু মিলে সিদ্ধান্ত নিল তারা খুলনা থেকে কক্সবাজার হয়ে সেন্টমার্টিন ঘুরতে যাবে। আমিতো এই সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করবো না।মেয়ে ছোট তো কি হয়েছে।। তারিখটা আজ আর আমার মনে নেই কিন্তু মনে আছে সড়ক পথে এটাই ছিল আমার সবচেয়ে লম্বা জার্নি। খুলনা থেকে ঢাকায় এলাম ১৩ ঘন্টায়।

ঢাকা থেকে বাস বদল করে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।বলে রাখি,তখনকার দিনে এখনকার মতো বিলাসবহুল বাস ছিলনা।কত কষ্ট যে হচ্ছিল।কিন্তু সব কষ্ট বিলীন হয়ে যাচ্ছিল সাগর দেখার আনন্দের কাছে।যেদিন আমি প্রথম সাগর দেখলাম তার অনুভূতি লিখে বুঝাতে পারবো না। সে অনুভূতি তুলনাহীন। কলাতলীর কাছে সামান্য উঁচু যে জায়গাটা থেকে প্রথমে সাগরকে দেখলাম আর চিৎকার করে উঠলাম -সেটা আমার এখনো কানে বাজে। পরবর্তীতে কতবার যে কক্সবাজার গিয়েছি,বছরে ৭/৮ বারও যাওয়া হয়। যতবারই যাই ততবারই সেখানে গিয়ে সেদিনের কথা মনে পরে।মনে হয় এ যেন প্রথম সন্তান জন্মদানের মতোই রোমাঞ্চকর। 

সেইন্টমার্টিন এর নাম তখন খুব একটা প্রচলিত নয়।হুমায়ূন আহমেদ এর দারুচিনি দ্বীপ 'বইটি পড়েই মনে হয় প্রথম জানলাম সেই দ্বীপের কথা। আমরা কক্সবাজারে দুইদিন কাটিয়ে পরের দিন গেলাম টেকনাফ। তখনতো
আর মেরীন ড্রাইভ ছিলনা। তবুও পুরনো সেই পাহাড়ি উঁচু নীচু সবুজ বনের ভেতর দিয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলা এ রাস্তা দেখেও কম মুগ্ধ হইনি। চোখেমুখে অপার মুগ্ধতা নিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম টেকনাফ। কিন্তু এ মুগ্ধতা বেশীক্ষণ স্থায়ী হয়নি যখন জানলাম জাহাজ নয় ছোট একটি কাঠের নৌকা দিয়ে পাড়ি দিতে হবে এ সাগর। সবাই যাচ্ছে।আমি এতটুকু বাচ্চা নিয়ে কিভাবে কি ? কিন্তু আমার তো আর পিছু ফিরে আসার উপায় নেই। আল্লাহর নাম নিয়ে উঠে পরলাম নৌকায়। তখনতো আর এখনকার মতো সহজ সুব্যবস্থা ছিলনা। এখনতো প্রায় প্রতিবছরই যাচ্ছি।আমার এখনো চোখে ভাসে মাঝারি সাইজের একটা নৌকায় বাবা তার পুতুলের মতো ছোট মেয়েটিকে কোলে নিয়ে বসে আছে চুপচাপ আর আমি,বড় ঢেউ এলেই ভয়ে চিৎকার করে উঠছি।

কলার খোলের মতো মনে হচ্ছিল নৌকাটিকে।সেদিন ভাবতে পারিনি যে এই জীবন নিয়ে ফিরে আসতে পারবো। আল্লাহর অশেষ রহমতে ভাসতে ভাসতে ভাসতে ভাসতে অবশেষে আমরা পৌঁছে গেলাম স্বপ্নের সেন্টমার্টিন। দেখে অবাক হলাম। নীল সাগরের মাঝে সবুজ একটা দ্বীপ। প্রবালদ্বীপ। এতো সুন্দর এতো সুন্দর! সুবহানাল্লাহ। আমাদের দলের সদস্য সংখ্যা ছিল ১৬ জন।তাদের মধ্যে আমার মেয়ে রোদাবা জামান আদৃতাই ছিল সর্বকনিষ্ঠ। লোকজন ভীষণ অবাক হয়ে গিয়েছিল এত ছোট বাচ্চা নিয়ে কিভাবে গেলাম। এর আগে নাকি এত ছোট কেউ যায়নি। আমরা ছিলাম হোটেল শৈবাল এ। প্রথম রাত গনরুমে থাকলে-ও পরের রাতে আলাদা কটেজ পেয়ে যাই। তখন খুব ভালো ব্যবস্থাপনা ছিলনা।

পরেরদিন খুব ভোরে সবাই যখন ঘুমাচ্ছে আমি একাই চলে গেলাম ভোরের সূর্যোদয় দেখবো বলে হুমায়ূন আহমেদ এর সমদ্র বিলাস এর সামনে। এখনো আমার এ অভ্যাসটি আছে। কোথাও ঘুরতে গেলে সেটা সাগর, পাহাড় বন বা বরফ যা-ই হোক আমি খুব ভোরে উঠে প্রকৃতি দেখি।আমার খুব ভালো লাগে ভোরের নির্মল প্রকৃতি। সাগরপাড়ে সূর্যকে অনেক বড় দেখায়। তখনও কিন্তু আমরা ছেড়া দ্বীপ গিয়েছিলাম পায়ে হেটে। আসাযাওয়ায় প্রায় ২৫ মাইল। জোয়ারের সময় দ্বীপটি মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বলে এর নাম ছেড়াদ্বীপ হয়েছে বলে জানলাম। তপ্ত বালি আর কেয়াবনের ভেতর দিয়ে হাটা মোটেও সহজ ছিলনা। গায়ের রঙ পুড়ে কালো হয়ে গেছে।পরবর্তী সময়ে সবাই আমাদের ভূত দেখার মতো চমকে উঠতো। প্রচুর ডাব খেয়েছি যাত্রাপথে। তখনকার ছেড়াদ্বীপ এতই সুন্দর ছিল।

জীবিত প্রবাল ফুলের মতো স্বচ্ছ পানি ভেদ করে দেখা যেত।দেখা যেত লাল নীল হরেক রঙের মাছ।কি যে সুন্দর কি যে সুন্দর। যারা সেন্টমার্টিন যায় কিন্তু ছেড়াদ্বীপ দেখে আসেনা তাদের অনেককিছুই দেখার বাদ থেকে যায়।
যদিও তখনকার মতো সুন্দর এখন আর নেই পর্যটকদের আধিক্যেজোয়ার শুরু হয়ে গেলে দ্বীপ ডুবে যাবে তখন আবার আমরা বিপদে পরে যাবো তাই এত সুন্দরকেও ছেড়ে চলে আসতে হলো তাড়াহুড়ো করে।

সন্ধ্যায় সাগরের তীরেক্লান্ত শরীরে বসে চা খাওয়া আর সাগরের গর্জন শোনা, মাথার উপরে বিশাল পূর্নিমার চাঁদ দেখতে দেখতে আড্ডা দেয়া সবকিছুই আলাদা দ্যোতনা এনে দিয়েছিল।মনে হচ্ছিল এই ক্ষন যদি শেষ না হতো।
আসার দিন আমি বোকার মতো একটা কাজ করেছিলাম।বস্তা ভরে শুটকি আর প্রবাল নিয়ে এসেছি যা ছিল কষ্টদায়ক।খুলনার মানুষতো শুটকির গন্ধই শুনতে পারেনা।পরেরদিন আবার সেই নৌকায় করে টেকনাফ আসা,সেখান থেকে কক্সবাজার হয়ে খুলনা যাওয়া।


আসলে সুন্দরকে ছুয়ে দেখতে ইচ্ছে করে।ইচ্ছে করে অবগাহন করতে।তবেইনা উপভোগ করা যায় প্রকৃতিকে।তখন আমাদের নিজস্ব কোন ক্যামেরা ছিল না তাই৷ বেশী ছবি তুলতে পারিনি। এখানে তখনকার দুইটা ছবি দিলাম।

 

মাহিনুর জাহান নিপু,নরসিংদী 


বিভাগ : জীবনযাপন


এই বিভাগের আরও