বিলুপ্তপ্রায় নরসিংদীর যাত্রাশিল্প, অস্তিত্ব সংকটে শিল্পীরা

২০ আগস্ট ২০২০, ০১:৩২ পিএম | আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:০৪ পিএম


বিলুপ্তপ্রায় নরসিংদীর যাত্রাশিল্প, অস্তিত্ব সংকটে শিল্পীরা

রাকিবুল ইসলাম:
বিনোদনের অন্যতম উৎস যাত্রাপালা। বাঙালি জাতির গ্রামীণ সংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসেবে হাজার বছর ধরে মিশে আছে যাত্রা গান। ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে গড়ে ওঠা জনপদ নরসিংদীর একসময়কার ঐতিহ্য যাত্রাপালা আজ বিলুপ্তির পথে। বিভিন্ন অবহেলা আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে এই শিল্প। ধর্মীয় গোঁড়ামি, জঙ্গিবাদের উত্থান, নাশকতা, মোড়ে মোড়ে টেলিভিশন, ডিস অ্যান্টেনা, পশ্চিমা বিশ্বের বিশেষ ধরনের অশ্লীল ছবির ছড়াছড়ির কাছে নুইয়ে পড়েছে বাঙালি জাতির লোকজ এই সংস্কৃতি।

আশির দশকের পর নরসিংদীতে সব মিলিয়ে প্রায় ১০টির মতো দল থাকলেও এখন অস্তিত্ব নেই একটিরও। নব্বইয়ের দশকে আজাদ অপেরা, নিউবাসন্তী অপেরা, নিউমুক্তি অপেরা, বেবি অপেরা, জয়দূর্গা অপেরা ইত্যাদি দলের পাশাপাশি নরসিংদীর স্থানীয় দল হিসেবে সুমি ও কাজল অপেরা দাপিয়ে বেড়াত নরসিংদীর বিভিন্ন অঞ্চল। একসময় যাত্রাশিল্পীদের কদর থাকলেও কালের বিবর্তনে এখন তাদের দুঃসময়। দুর্গাপূজা বা বড় ধরনের লোকজ অনুষ্ঠান ছাড়া ডাক পড়ে না তাদের।

জানা যায়, যাত্রাপালার ঐতিহ্য অত্যন্ত প্রাচীন। যাত্রা’র সূচনা হয় খ্রিস্টপূর্ব কয়েক হাজার বছর আগে। তখন মানুষ দেব-দেবীদের বন্দনা করতো। তখন দল বেঁধে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ‘যাত্রা’ করার থেকে এর নাম ’যাত্রা’। ১৫০৯ সালে যাত্রার সাথে শ্রী চৈতন্য দেবের সময়ে যাত্রায় অভিনয় যুক্ত হয়। ‘রুক্ষ্মীনি হরন’ প্রথম যাত্রা পালা। অষ্টম ও নবম শতকেও এদেশে পালাগান ও পালার অভিনয় প্রচলিত ছিল। শ্রী চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের আগেও রাঢ়, বঙ্গ, সমতট, গৌড়, পুল্র, চন্দ্রদ্বীপ, হরিকেল, শ্রীহট্টসহ সমগ্র ভূখণ্ডে পালাগান ও কাহিনিকাব্যের অভিনয় প্রচলিত ছিল। ধর্মীয় বা কোনো উত্সবে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার যে রীতি সেখান থেকেই যাত্রা শব্দটি এসেছে। এদেশে শিবের গাজন, রামযাত্রা, কেষ্টযাত্রা, সীতার বারোমাসী, রাধার বারোমাসী প্রচলিত ছিল। অষ্টাদশ শতকে যাত্রা বাংলা ভূখণ্ডের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় শিশুরাম, পরমানন্দ অধিকারী, সুবল দাস ছিলেন যাত্রার জগতে প্রসিদ্ধ।


উনবিংশ শতকে পৌরাণিক কাহিনিভিত্তিক যাত্রা খুব জনপ্রিয়তা পায়। উনবিংশ শতকের শেষে এবং বিশশতকের শুরুর দিকে যাত্রায় দেশপ্রেমমূলক কাহিনির অভিনয় শুরু হয়। বিখ্যাত সাহিত্যিক মীর মোশাররফ হোসেনও পালা লিখেছেন। তিনি বেহুলা নিয়ে যাত্রাপালা লেখেন। সে সময় গ্রামে গঞ্জে বিষাদসিন্ধুর কাহিনি নিয়েও যাত্রা অভিনয় হতো। কারবালার কাহিনি নিয়ে যাত্রা পালা লেখা হতো।

যাত্রা শিল্প বিলুপ্তির পেছনে অশ্লীলতা ও প্রিন্সেসদের আগমন নিয়ে প্রশ্ন করলে যাত্রা শিল্প উন্নয়ন পরিষদের এক নেতা বলেন, যারা পেশাদার যাত্রাশিল্পী তারা কখনোই এসব অশ্লীলতা বা উলঙ্গ নৃত্যের সাথে জড়িত নয় বরং আয়োজকরাই তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থে হাউজি খেলা ও অশ্লীল নৃত্যের আয়োজন করত। নামকরা শিল্পী, কলাকুশলী দ্বারা এই যাত্রাদল গঠন করা হতো। যাত্রা দলে দেশজুড়ে এখনও হাজারো শিল্পী, কলাকুশলী রয়েছেন যারা এই পেশা ছাড়া অন্য পেশা জানেন না, ফলে তাদের এখন বড়ই দুর্দিন।
এই বিষয়ে যাত্রা দলের যন্ত্রকারিগর মোহাম্মদ হাসান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমি ছোটকাল থেকে এই পেশায় জড়িত এবং এখনও এই পেশা নিয়ে স্বপ্ন দেখি। অন্য কোনো কাজ শিখিনি বলে অনেকটা দুর্দশায় কাটছে আমাদের দিন। এখন আমাদের খোঁজ নেয়ারও কেউ নেই।

নব্বইয়ের দশকে নরসিংদীসহ সারা বাংলাদেশে মঞ্চ কাপানো নায়িকা দীপ্তি রানী অভিমানের সুরে বলেন, আমরা না পারছি কারও কাছে হাত পাততে, না পারছি পেটের ক্ষুধা চাপিয়ে রাখতে। বাঁচতে হবে শুধু এজন্যই বেঁচে আছি। কখনো কল্পনাও করিনি আমাদের ভাতের কষ্ট করতে হবে ।

যাত্রাশিল্পের এই দুর্দশা নিয়ে যাত্রা শিল্প উন্নয়ন পরিষদ কেন্দ্রিয় কমিটির সহ-সভাপতি ও নরসিংদী জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আজাদ কালাম বলেন, ধর্মীয় গোড়ামী, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাসহ বিভিন্ন কারণে আজকে এই শিল্প বিলুপ্ত প্রায়। প্রশাসন এখন যাত্রার নামই শুনতে চায় না। সরকার যদি সহজে পারমিশন দেয় তাহলে এখনও ভালো চলবে যাত্রাশিল্প। সরকারি উদ্যোগে যদি প্রতিটি জেলায় শিল্পকলা একাডেমির মাধ্যমে যাত্রার মঞ্চায়ন করার ব্যবস্থা করে দেয়া যায় তাহলে আবার এই শিল্পের সুদিন ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করছেন এই শিল্পী।


বিভাগ : বিনোদন


এই বিভাগের আরও