রমজানকে ঘিরে বাজারে ক্যামিকেল মিশ্রিত অপরিপক্ক ফল

১৪ মে ২০১৯, ০৪:৩০ পিএম | আপডেট: ২৭ মার্চ ২০২৪, ০২:৫৭ পিএম


রমজানকে ঘিরে বাজারে ক্যামিকেল মিশ্রিত অপরিপক্ক ফল

নিজস্ব প্রতিবেদক :

রমজান মাসকে সামনে রেখে বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন বিভিন্ন চক্র। রোজায় ইফতারে ভাজা পোড়ার পাশাপাশি ফল খেতে পছন্দ করেন অনেকেই। এতে রমজান মাসে বেড়ে যায় ফলের চাহিদা। চাহিদার এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অতি মুনাফার আশায় কেমিক্যাল মেশানো অপরিপক্ক ফল বাজারজাত শুরু করেছে একাধিক চক্র।

মৌসুম শুরু না হলেও ইতোমধ্যে এসব মৌসুমী ফলে সয়লাব হয়ে গেছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বাজার। আম, জাম, লিচু, আনারস, কাঠাল থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরনের মৌসুমি ফল পাওয়া যাচ্ছে ফলের দোকানগুলোতে। বেশি দাম পাওয়ার আশায় বিভিন্ন কেমিক্যাল মিশিয়ে এসব ফল বাজারে ছাড়া হচ্ছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসময়টাতে বাজারে যে সব মৌসুমি ফল পাওয়া যাচ্ছে তা বাজারে আসার কথা আরো সপ্তাহ দুয়েক পরে। কিন্তু আমরা রাসায়নিক দ্রব্যাদি দিয়ে পাকানো ফল খাচ্ছি। যা সারাদিন রোজা রাখার পর স্বাস্থ্যের জন্য হুমকির স্বরুপ। স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনায় এমন পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারে ওঠা এসব আম, লিচু ল্যাবে পরীক্ষা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, এসব আমে কেমিক্যাল পাওয়া গেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, রোজার প্রথম দিন থেকেই রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, কাঁটাবন, মহাখালী কাঁচা বাজার, কারওয়ান বাজারে তরমুজ. পাকা আম, লিচুতে ভরপুর হয়ে উঠে কারওয়ানবাজারের ফলের আড়ৎ। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বিক্রি হতে দেখা যায় হলুদ-সবুজ আম আর লিচু । রোজার প্রতিদিন একই চিত্র দেখা গেছে এসব এলাকায়। রাজধানীর ফার্মগেট ও মহাখালীতেও ছিল একই চিত্র। আর প্রতিটি স্থানেই আম, লিচু, তরমুজ, আনারস কিনতে ক্রেতাদের মধ্যে বাড়তি আগ্রহ লক্ষ্য করা গেছে।

রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ক্রেতাদের আগ্রহকে কাজে লাগিয়ে বেশি দামে এসব ফল বিক্রি করছে ফল ব্যবসায়ীরা। যেখানে এপ্রিলে শুধুমাত্র তরমুজের কেজি ৩০ থেকে ৪৫ টাকা ছিল। এখন তা ৯০ থেকে ১০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। আর ১০০ লিচু বিক্রি হচ্ছে ৬০০ থেকে ৮০০ টাকায়। আর আম ১৫০-১৬০ টাকা কেজি। ফলে সরকার ও ব্যবসায়ীর পক্ষ থেকে রমজানে দ্রব্যমূল্য সহনশীল রাখার ঘোষণা দেয়া হলেও সেই প্রতিশ্রুতি এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে।

বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ এই দুই মাসকে মধু মাস বলা হলেও সরকার ঘোষিত ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২০ মে থেকে গুটি আম বাজারে উঠার মধ্য দিয়ে শুরু হবে আমের মৌসুম। ২৫ মে গোপালভোগ ও ২৮ মে খিরসাপাত আম বাজারে আনতে পারবেন ব্যবসায়ীরা। অথচ এখনই অপিরপক্ক আম বিভিন্ন রাসায়নিক দিয়ে পাকিয়ে বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে।

চাপাই নববাগঞ্জের কানসাটের লিচু ব্যবসায়ী মাহিদুর রহমান বলেন, প্রতিবছর গুটি অবস্থায় লিচুর বাগান কিনে নিয়ে প্রথমে ফল গঠনে সহায়তা করার জন্য জৈব উজ্জীবক ট্রায়াকন্টানল, ম্যানকোজেব ছিঁটিয়ে গোটা গাছ ভিজিয়ে দেয়া হয়। এরপর ছত্রাকনাশক ল্যাম্বডা সাইহ্যালেথ্রিন প্রয়োগ করার পর ফল একটু বড় হলে নিয়মিত বিরতিতে কার্বেন্ডাজিম ও সাইফারমেথ্রিন নামের কীটনাশক ছিঁটানো হয়। লিচু রসাল হওয়ার কয়েক দিন আগে থেকে ম্যানকোজেব, ট্রায়াকন্টানল, বোরন ও হরমোনজাতীয় নানা ওষুধ ছিঁটাতে হয়। ওষুধ না ছিটালে লিচু দেরিতে পাকে ও রং খুব একটা ভালো হয় না। লিচুর রং টকটকে লাল না হলে বাজারে ভালো দাম পাওয়া যায় না।

কাঁটাবন বাজারে ফলক্রেতা আফজাল হোসেন বলেন, মৌসুমি ফলে যে রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হচ্ছে, তা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। এটা জেনেও আমরা আম-লিচুর টসটসে রং ও আকার দেখে আকৃষ্ট হচ্ছি। ব্যবসায়ীরা ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে রাসায়নিক পদার্থের প্রভাবে মৌসুমি ফল পাকাচ্ছেন, এটা প্রতিরোধ করা উচিত।

পুরান ঢাকার বাদামতলীর ফল ব্যবসায়ী রাসেল মিয়া বলেন, ‘আগাম বাজার ধরার জন্য লিচুতে এক ধরনের ভিটামিন স্প্রে করলে অল্প সময়ে তা বাজারে তোলা যায়। সব ফল ব্যবসায়ীই একটু বেশি লাভের জন্য এই কাজটা করে থাকে।

বি আর বি হাসপাতালের প্রধান পুষ্টিবিদ ইশারাত জাহান বলেন, ফল ব্যবসায়ীদের প্রধান লক্ষ্য থাকে মুনাফা করা। এ জন্য তারা ফলে যেসব রাসায়নিক ব্যবহার করেন, সেগুলোর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। পুষ্ট হওয়ার আগেই কৃত্রিম উপায়ে পাকানোর ফলে ফলগুলোর পুষ্টিমান থাকে না। এ জন্য অনেক ফলের স্বাদ তেতো হয়ে যায়।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, আমের সঙ্গে ক্যালসিয়াম কার্বাইডের প্যাকেট রাখলেই শুষ্ক পরিবেশে এ থেকে এসিটাইলিন গ্যাস তৈরি হয়ে কৃত্রিম উপায়ে আম পেকে যায়। কার্বাইড এর তৈরি গ্যাস ইথিলিন গ্যাসের মতোই কাজ করে যা কম সময়ে আম পাকাতে সাহায্য করে। তবে প্রচলিত কার্বাইড ব্যবহারের পরিবর্তে অসাধু ব্যবসায়ীরা ইদানিং ধরন পাল্টে এখন ইথোফেন নামের বিষাক্ত হরমোনাল স্প্রে ব্যবহার করে আমকে হলুদ বর্ণে রূপান্তরিত করছে। এ উপায়ে কেবল আম নয়, অন্য ফলও পাকানো সম্ভব। বাজারে এখন যে আম, লিচু ও তরমুজ দেখা যাচ্ছে প্রায় সবকটি বিষাক্ত হরমোনাল স্প্রে করে পাকানো হয়েছে।

পুরান ঢাকার বাদামতলীতে দীর্ঘদিন ধরে ফলের ব্যবসা করেন রাসেল মিয়া তার দোকানেও বিক্রি হচ্ছিল হলুদ-সবুজ রঙের পাকা আম, তথা ‘সাতক্ষীরার গোবিন্দভোগ’। রাসেল মিয়া বলেন, ‘বাজারে গোবিন্দভোগ আসতে আরো ১৫ দিন সময় লাগবে। সবাই বিক্রি করছে। তাই বাধ্য হয়ে আর দশজনের মতো আমাকেও বিক্রি করতে হচ্ছে। নতুবা ক্রেতা এসে ঘুরে যাবে।

অপর লিচু ব্যবসায়ী আলতাফ হোসেন বলেন, সবাই জানে মৌসুম শুরু হয়নি। তারপরও কিনছে। আমরাও বিক্রি করছি। আর বলার সময় বলে বিক্রি করছি যে এখনো লিচু মিষ্টি নয়।

কারওয়ান বাজার থেকে ‘পাকা আম’ কিনছিলেন আব্দুল করিম। তিনি বলেন, ‘আমের মৌসুম আসেনি এটা জানি। তারপরও আম কিনলাম। রোজার মাস। মহিলারা খেতে চায়।’ এসব আম কী স্বাস্থ্যকর এমন প্রশ্নের উত্তরে করিম বলেন, ‘সরকার বিক্রি করতে না দিলে এসব ফল কেনার ক্ষমতা কি আমার আছে? যে বিক্রি করছে, তার কী বিক্রি করার ক্ষমতা আছে? বিক্রি বন্ধ করতে হলে সরকারকেই করতে হবে।’

কৃষি সস্প্রসারণ অধিদফতর বলছে, দেশের কোথাও আম বা লিচুর চূড়ান্ত ফলন শুরু হয়নি। কিছু কিছু গাছে দুয়েকটি আম পাকতে শুরু করেছে। যে পরিমাণে আম পাকছে, তা কেবল পরিবারের সদস্যদের চাহিদা মেটানোর উপযোগী। সাতক্ষীরা আমের জন্য নাম করা হলেও জেলাটিতে এখনো আম উত্তোলন শুরুই হয়নি।

আমের রাজধানী হিসেবে খ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জেও আমের মৌসুম শুরু হবে এ মাসের শেষ দিকে।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক আরেফিন মাসুম বলেন, ফলের মান পরীক্ষার জন্য আমাদের কোনো ল্যাব নেই। ফলে আমরা চাইলেও অভিযান পরিচালনা করতে পারছি না। এমতাবস্থায় ক্রেতাদের সচেতন হতে হবে। সবাই সচেতন না হলে এটা সবার জন্যই স্বাস্থ্য ঝুকিঁ।


বিভাগ : বাংলাদেশ


এই বিভাগের আরও