ব্যক্তি ও রাজনৈতিক জীবনে আইভী রহমান

২১ আগস্ট ২০২০, ০৬:০৩ পিএম | আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:১২ এএম


ব্যক্তি ও রাজনৈতিক জীবনে আইভী রহমান

নিজস্ব প্রতিবেদক:

আজ ভয়াবহ ২১ আগস্ট। ২০০৪ সালের এই দিন গ্রেনেড হামলায় আহত হওয়ার পর ২৪ আগস্ট প্রাণ হারান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক মহিলা বিষয়ক সম্পাদক প্রয়াত আইভী রহমান। তার স্বামী বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি মরহুম জিল্লুর রহমান। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দু’জনের অবদানই ছিল উল্লেখযোগ্য। একে অপরের ছায়া হয়ে পার করেছেন নিজেদের রাজনৈতিক জীবন। ২১ আগস্টের সেই ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার দিনটিতেও দু’জন ছিলেন একসাথে। তবে ট্রাকে থাকায় ওইদিন বেঁচে যান জিল্লুর রহমান। নিচেই দাঁড়িয়ে থাকা আইভী স্প্রিনটারে ক্ষত বিক্ষত হন। ওই হামলায় গুরুতর আহত হওয়ার পর দুই পা ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তার। এরপর আর বাঁচানো সম্ভব হয় না তাঁকে।

প্রয়াত আইভী রহমান ৭ জুলাই ১৯৪৪ তারিখে ঢাকায় জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মরহুম জালাল উদ্দিন আহমদ এবং মাতার নাম মরহুমা হাসিনা বানু। তিনি ২৭ জুন ১৯৫৮ তারিখে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর স্বামী বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি মরহুম জিল্লুর রহমান। তিনি ১৯৬০ সালে বাংলা বাজার স্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি ১৯৬৯ সালে ইডেন মহিলা কলেজ থেকে স্নাতক এবং ১৯৭২-৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম,এ পরীক্ষার্থী ছিলেন।

আইভি রহমান তাঁর জীবনব্যাপী রাজনীতি ও সমাজসেবার মাধ্যমে দেশ ও দেশের মানুষের, বিশেষ করে পশ্চাতপদ নারী সমাজের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট ছিলেন। প্রতিটি আন্দোলনে, সংগ্রামে তিনি ছিলেন পুরোভাগে। জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলন ও সংগ্রামকে মহিমান্বিত করে গেছেন। এর বিনিময়ে তিনি কিছু চাননি, সেই আকাঙ্ক্ষাও কোন দিন পোষণ করেননি।

ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতিতে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। ১৯৬২ সালের শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিল আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণ অভ্যুত্থানে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার আহবানে ১৯৭১ এর ৭ মার্চের পর সৈয়েদা সাজেদা চৌধুরীর নেতৃত্বে তাঁর ইন্দিরা রোডস্থ বাসভবনে রাইফেল চালনা ও ফাষ্ট এইড বিষয়ক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বেগম বদরুন্নেছা ও সৈয়দা সাজেদা চেীধুরীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে স্থাপিত ক্যাম্পগুলোতে খাবার, ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সরবরাহ করতেন।

মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ ও মনোবল বৃদ্ধির জন্য স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রায়ই কথিকা পড়তেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হ্নদয়বিদারক ঘটনার পর থেকে জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

তিনি নারী জাগরণে রেখে গেছেন বলিষ্ট ভূমিকা। তিনি ১৯৭২-১৯৭৬ পর্যন্ত বাংলাদেশ মহিলা সমিতি’র সাধারণ সম্পাদিকা এবং ১৯৭৬-২০০৩ পর্যন্ত সহ সভানেত্রী এবং ২০০৪ সালে সভানেত্রী’র দায়িত্ব পালন করেন। তিনি আগস্ট ১৯৯৬ থেকে সেপ্টেম্বর ২০০১ পর্যন্ত জাতীয় মহিলা সংস্থার সভানেত্রী’র দায়িত্ব পালন করেন।

আজ যে বিশাল ১২তলা মহিলা সংস্থা ভবন, আইভী রহমানের হাতে গড়া। মহিলা জাগরণের যে স্বপ্ন দেখতেন তার ভিত্তি রচনায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে এ অট্টালিকা নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করেন। তাঁর দায়িত্ব পালনকালেই ৬ তলা পর্যন্ত নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছিল।

তিনি মহিলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কার্যকরী কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫, ১৯৮২ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত জাতীয় অন্ধ কল্যাণ সমিতি’র সাধারণ সম্পাদিকার দায়িত্ব পালন করেন। তাছাড়া তিনি ১৯৯৯-২০০৪ পর্যন্ত এ্যসিড সার্ভাইবার ফাউন্ডেশন এর প্রতিষ্ঠাতা ট্রাষ্ট্রি সদস্য হিসাবে মহান ভূমিকা রাখেন।

তিনি ছিলেন এ্যাসোসিয়েট কান্ট্রি ওমেন অব দি ওয়ার্ল্ড এর এরিয়া প্রেসিডেন্ট (সেন্ট্রাল এ্যান্ড সাউথ এশিয়া), জাতীয় যৌতুক প্রতিরোধ সমিতি, বাংলাদেশ প্ল্যানিং এসোশিয়েশন এবং বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির সদস্য ছিলেন।

প্রয়াত আইভী রহমান ১৯৮১ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত সময়ে মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ছিলেন। তাছাড়া ১৯৭৮-২০০৪ পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা’র দায়িত্ব পালন করেন।

পুরস্কার ও সম্মাননা: * স্বাধীনতার পদক ২০০৯। * এসিড সার্ভাইবার ফাউন্ডেশন ২০০৯। * স্বাধীনতার রজত জয়ন্তীতে বাংলাদেশ মহিলা সমিতি সংবর্ধনা ১৯৯৬। * নাগরিক নাট্যাঙ্গন এবং সোনার বাংলা যুব কল্যাণ পরিষদ ‘মুক্তিযুদ্ধ পদক’। * আমেরিকান বায়োগ্রাফি ইনস্টিটিউট থেকে ওমেন অব দি ইয়ার ২০০০ নির্বাচিত হন। * মহিলা সমিতি কর্তৃক ‘নারী অধিকার মানব অধিকার’ পদক।

মরহুমা আইভি রহমান স্কুল জীবনে মুকুল ফৌজ, গার্লস গাইডে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সমাজসেবা শুরু করেন। বাংলাদেশ মহিলা সমিতির জন্মলগ্ন থেকে আমৃত্যু তিনি মহিলাদের উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান থাকাকালীন তিনি নারী আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে, সমন্বয় সাধনের লক্ষ্যে অনবদ্য ভুমিকা রাখেন। দলমত নির্বিশেষে নারী ও মানবাধিকার সংগঠনের প্রতি ছিল তার অকুন্ঠ সমর্থন। সর্বক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়ন ও অধিকার আদায়ে তিনি আজীবন ছিলেন একজন নিরলস যোদ্ধা।

গত ২০০৪ সালের ২১ আগষ্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে সন্ত্রাসীদের গ্রেনেড হামলায় মারাত্মকভাবে আহত হয়ে দীর্ঘ ৫৮ ঘন্টা মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে তাঁর জীবনাবসান ঘটে।


বিভাগ : বাংলাদেশ