করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯): ‘উচ্চ ঝুঁকিতে’ বাংলাদেশ

০৫ মার্চ ২০২০, ১২:২২ পিএম | আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:১২ পিএম


করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯): ‘উচ্চ ঝুঁকিতে’ বাংলাদেশ
ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

নতুন করে ভারত ও ইন্দোনেশিয়ায় করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী পাওয়ায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। এতে জানানো হয়েছে, এই অঞ্চলের ১১টি দেশের মধ্যে ৫ টি দেশে এরই মধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষ মিলেছে। অন্য ৩ টি দেশ হলো নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ড। বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলের বাকি দেশগুলো এখনো করোনাভাইরাসমুক্ত রয়েছে। তবে এ দেশগুলোকে এ ব্যাপারে আরো সতর্ক থাকতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক ড. পুনম ক্ষেত্রপল বুধবার (৪ মার্চ ) বিকেলে এই দেশগুলোর স্বাস্থ্য খাতের সাংবাদিকদের কাছে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ কথা জানিয়েছেন।

এদিকে বিদেশ ভ্রমণকারী ৩ জনকে দেশে সরকারের কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে তাদের নমুনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় দেশে ১১ জনকে আইসোলেশনে নেওয়া হলেও নমুনা পরীক্ষায় রিপোর্ট নেগেটিভ আসায় তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া বুধবার বিকেল পর্যন্ত দেশে মোট সন্দেহজনক উপসর্গ থাকা ১০৫ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। কারো মধ্যেই এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়নি। ৩ জনের ফলাফল প্রক্রিয়াধীন বলে জানিয়েছেন সরকারের করোনাভাইরাস বিষয়ক মুখপাত্র এবং রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ড. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক ড. পুনম ক্ষেত্রপল বিবৃতিতে জানিয়েছেন, নতুন করোনাভাইরাস যেহেতু বিশ্বব্যাপী উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি করেছে, তাই এটি নিয়ে সবারই সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষ করে এই ভাইরাস প্রতিরোধ, শনাক্তকরণ ও ব্যবস্থাপনায় কোনো ধরনের অসতর্কতা থাকলে তা ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি আরো বেড়ে যায়। এ জন্য জনসচেতনতা সবচেয়ে বড় একটি পদক্ষেপ।

করোনাভাইরাস প্রতিরোধে দেশে উচ্চ পর্যায়ের ৩ টি শক্তিশালী কমিটি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক। বুধবার বিকেলে রাজধানীর মহাখালীতে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, নতুন করোনাভাইরাস বর্তমানে বিশ্বের ৭০টিরও বেশি দেশে প্রবেশ করেছে। আমাদের দেশেও এই ভাইরাসটি চলে আসতে পারে। যদি ভাইরাসটি চলে আসে তার প্রতিকারে স্বাস্থ্য খাতের সব ধরনের প্রস্তুতি রাখা হয়েছে। তিনি জানান, দেশের সব বন্দরে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। ডাক্তার-নার্সদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রস্তুত রাখা এবং সার্বক্ষণিক হটলাইন খোলা রাখার ব্যাবস্থার পাশাপাশি দেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলা ও আন্ত মন্ত্রণালয়ভিত্তিক ৩ স্তরের শক্তিশালী কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি উপজেলায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসক ও আন্ত মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রে তাঁর (স্বাস্থ্যমন্ত্রী) নেতৃত্বে মন্ত্রিপরিষদসচিব, মুখ্য সচিব, স্বরাষ্ট্রসচিবসহ এডিবি, বিশ্বব্যাংক, ইউনিসেফ ও ইউএসএআইডিসহ ৩১ সদস্যের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং দেশে কোনো কারণে করোনাভাইরাস চলে এলেও তা আশঙ্কার কারণ হতে পারবে না।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে বুধবার জানানো হয়েছে, দেশের বাইরে থেকে আসা মোট চার লাখ ৪৩ হাজার ৯২ জনকে স্ক্রিনিং করা হয়েছে। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় বিভিন্ন বন্দরে ১৪ হাজার ৭১৩ জনকে স্ক্রিনিং করা হয়। অন্যদিকে দেশের বাইরে ইতালিতে একজন বাংলাদেশি নাগরিকের শরীরের করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। এ ছাড়া আরব আমিরাত ও সিঙ্গাপুরে ৩ জন বাংলাদেশি নাগরিক এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে আছে। চীনফেরত ২৩ জন বাংলাদেশি নাগরিক কোয়ারান্টাইনে আছেন দিল্লিতে। এখন পর্যন্ত আর কোথাও বাংলাদেশি কোনো নাগরিক করোনাভাইরাস আক্রান্ত হননি। সিঙ্গাপুরে হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে আরো ৪ জন নিজ নিজ কর্মস্থলে আবাসিক ব্যবস্থাপনায় রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বুধবার বিকেল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ১৪ জন আইইডিসিআর থেকে করোনাভাইরাস বিষয়ক সেবা নিয়েছে।

বাংলাদেশসহ ২৫ দেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা: বাংলাদেশসহ ২৫টি দেশের জন্য ৩ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলার সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগিতা সংস্থা (ইউএসএআইডি)। বিশ্বব্যাপী নভেল করোনাভাইরাস (কভিড-১৯) ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে ইউএসআইডি প্রশাসক মার্ক গ্রিন তাঁর সংস্থার সংক্রামক রোগবিষয়ক জরুরি তহবিল থেকে ওই সহযোগিতা দেওয়ার ঘোষণা দেন। ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস গত মঙ্গলবার এ তথ্য জানায়।

করোনাভাইরাস সংক্রমিত বা সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকি বিবেচনা করে সহযোগিতা দিতে ওই ২৫টি দেশ চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়াও ওই তালিকায় আছে আফগানিস্তান, অ্যাঙ্গোলা, ইন্দোনেশিয়া, ইরাক, কাজাখস্তান, কেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, তাজিকিস্তান, ফিলিপাইন, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, জাম্বিয়া, জিম্বাবুয়ে, বার্মা (মিয়ানমার), কম্বোডিয়া, ইথিওপিয়া, কিরগিজস্তান, লাওস, মঙ্গোলিয়া, নেপাল, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম।

যুক্তরাষ্ট্র সরকার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, অন্যান্য বহুপক্ষীয় প্রতিষ্ঠান ও ইউএসএআইডির কর্মসূচি বাস্তবায়নকারী অংশীদারদের পরিচালিত প্রকল্পের জন্য এই তহবিল দিচ্ছে। এটি গত ৭ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পররাষ্ট্র দপ্তর প্রতিশ্রুত ১০ কোটি ডলারের প্রথম কিস্তি।

ইউএসএআইডি প্রশাসক বলেছেন, বিশ্বের যেকোনো জায়গার সংক্রামক রোগ সর্বত্রই হুমকির কারণ হয়ে উঠতে পারে বিধায় আমরা অন্য দাতাদেরও কভিড-১৯ মোকাবেলার লড়াইয়ে সহায়তা করার আহ্বান জানাই।

ইতালি, ইরান ও দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিকদের ‘আগমনী ভিসা’ বন্ধ হচ্ছে: করোনাভাইরাস সংক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে ইতালি, ইরান ও দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিকদের বাংলাদেশে ‘ভিসা অন অ্যারাইভাল’ (আগমনী ভিসা) সাময়িকভাবে বন্ধ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত মঙ্গলবার এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে। এর আগে বাংলাদেশ চীনা নাগরিকদের ভিসার ক্ষেত্রেও আগমনী ভিসার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জরুরি প্রয়োজনে ইতালি, ইরান ও দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিকদের এ দেশে আসতে হলে ওই দেশগুলোতে বাংলাদেশ মিশনে তাদের ভিসা আবেদনের সময় তারা ‘করোনাভাইরাস সংক্রমিত নন’—এমন সনদ দিতে হবে। ইতিমধ্যে যারা ভিসা পেয়েছে তাদের বাংলাদেশে আসার ক্ষেত্রে অবশ্যই ওই সনদ সঙ্গে রাখতে হবে।

এদিকে কুয়েত সরকার বাংলাদেশ, ভারতসহ ১০টি দেশের নাগরিকদের সে দেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে ‘করোনাভাইরাস সংক্রমিত নয়’—এমন সনদ বাধ্যতামূলক করেছে। কুয়েতে বাংলাদেশ দূতাবাস জানিয়েছে, কুয়েত সরকার ওই দেশে সব ধরনের সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠান সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ করেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কুয়েতে বাংলাদেশ দূতাবাসে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৭ মার্চ, ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস ও ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসসহ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানগুলো আপাতত উদ্যাপন করা সম্ভব হবে না।

একই কারণে ইতালির মিলানে বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেলে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে আগামী ৮ মার্চের অনুষ্ঠান স্থগিত করেছে।

সব বন্দরে এখনই থার্মো স্ক্যানার জরুরি : বাংলাদেশের সব ধরনের বন্দরে থার্মো স্ক্যানার স্থাপনের ব্যাপারে জোর দিয়ে চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেছেন, কারণ এ দেশের নিরাপত্তার জন্য তা খুবই দরকার। শুধু চীন নয়, যেকোনো স্থান থেকে করোনো ছড়াতে পারে। বুধবার কেরানীগঞ্জের পানগাঁওয়ে চায়না রেলওয়ে গ্রুপ কম্পানি লিমিটেড (সিআরইসি) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।

চীনে করোনাভাইরাসের কারণে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প ও পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের কাজের ধারাবাহিকতা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে কি না সে বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছে সিআরইসি।

চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেন, বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের মাত্র ১০ শতাংশ ঘটেছে চীনে। বাকি ৯০ শতাংশ ঘটেছে বিশ্বের অন্যান্য দেশে। ঘটনা ও সংখ্যা নিয়ে গুজব রয়েছে।

চীন ও বাংলাদেশ হাতে হাত ধরে এগিয়ে চললে পরিস্থিতি উতরানো যাবে মন্তব্য করে চীনের রাষ্ট্রদূত বলেন, তিনটি মূল কথা আমি বলতে চাই। প্রথমত, চীন করোনাভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, চীনের প্রকল্প চালু ও বিনিয়োগ অব্যাহত রয়েছে। তৃতীয়ত, আমি বাংলাদেশ সরকার ও মানুষকে বলতে চাই, চীন এ সংকট জয় করবে। তিনি আরো বলেন, যেকোনো ধরনের বড় সমাবেশ পরিহার করতে হবে। যদি ধর্মীয় রীতি পালন করতে হয় তাহলে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা দরকার।

সংবাদ সম্মেলনে প্রকল্প পরিচালক ওয়াং কুন বলেন, প্রকল্প দুটির কাজের চলমান ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। আমরা দুটি লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। প্রথমত, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প ও পদ্মা বহুমুখী প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত সব কর্মকর্তা যেন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে নিরাপদে থাকেন সে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। দ্বিতীয়ত, এসব কারণে কাজের গতি যেন কমে না যায় তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া। তিনি জানান, প্রকল্পে জড়িত যেসব কর্মকর্তা এর মধ্যে চীনের হুবেই প্রদেশে গিয়েছেন তাঁদের বাংলাদেশে আনা হচ্ছে না। তা ছাড়া যাদের আসা প্রয়োজন তাঁদের সেখানেই দুই সপ্তাহ পর্যবেক্ষণের জন্য ‘কোয়ান্টেরাইন’ অবস্থায় রাখা হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, পদ্মা সেতু প্রকল্পে ৬৬৬ জন চীনা নাগরিক কাজ করছেন। মূল সেতুর মোট ৪১টির মধ্যে ২৫টি স্প্যান উঠেছে। সর্বোপরি এ প্রকল্পে ৮৫.৬৫ শতাংশ দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে।


বিভাগ : বাংলাদেশ


এই বিভাগের আরও