রায়পুরার মেঘনায় বালু উত্তোলনের মহোৎসব: ভাঙ্গনে বিলীন হচ্ছে শতশত বাড়িঘর

২৪ জুলাই ২০২০, ০১:২৩ এএম | আপডেট: ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৫:৩৭ এএম


রায়পুরার মেঘনায় বালু উত্তোলনের মহোৎসব: ভাঙ্গনে বিলীন হচ্ছে শতশত বাড়িঘর

নিজস্ব প্রতিবেদক:

নরসিংদীর রায়পুরার চরাঞ্চলের তিন ইউনিয়নের মেঘনা নদীর অব্যাহত ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে শত শত ঘরবাড়ি, হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে বিভিন্ন গ্রাম। এতে খোলা আকাশের নীচে ও অন্যের বাড়িতে মানবেতর জীবনযাপন করছেন ঘরবাড়ি হারানো মানুষ। অনেকে এলাকা ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন অন্যত্র। মেঘনা নদীতে যত্রতত্র ড্রেজার মেশিন বসিয়ে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের মহোৎসবের ফলে নদী ভাঙ্গনের সৃষ্টি হলেও স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারি নেই বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।


সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, প্রতি বছরের মতো এবারও বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই রায়পুরায় মেঘনা নদীতে দেখা দিয়েছে ভাঙ্গন। এতে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে চরাঞ্চলের চাঁনপুর, চরমধুয়া ও শ্রীনগর ইউনিয়নের ১২টি গ্রামের শত শত বাড়িঘর, গাছপালাসহ ফসলী জমি। দীর্ঘদিন ধরে অব্যাহত ভাঙ্গনের ফলে হুমকির সম্মুখীন এসব ইউনিয়নের অনেক গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ঈদগাহ মাঠ, মসজিদ, কবর স্থান ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র। গত ১০ দিনে চরাঞ্চলের  তিন ইউনিয়নে শতাধিক বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এরমধ্যে চাঁনপুর ইউনিয়নে ১৫টি বাড়িঘরসহ পুরো ইমামদিরকান্দি গ্রাম নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। একই ইউনিয়নের কালিকাপুর ও সদাগরকান্দি গ্রামে ২৫টি বসতভিটা ও অনেক ফসলি জমি নদী গর্ভে চলে গেছে।

শ্রীনগর ইউনিয়নের পলাশতলী গ্রামে একটি মসজিদসহ ৩০টি বাড়িঘর মেঘনার ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। চরমধুয়া ইউনিয়নের বীরচরমধুয়া গ্রামে নতুন করে ২০টি পরিবার ভাঙনের শিকার হয়েছে। ঝুঁকিতে রয়েছে গ্রামটির একটি কমিউনিটি ক্লিনিক, প্রাইমারী স্কুল, মসজিদ, মাদরাসা, কবরস্থান ও ঈদগাঁ। গত বছর চাঁনপুর, চরমধুয়া ও বীরচরমধুয়া গ্রামের শতাধিক পরিবার মেঘনার ভাঙনে গৃহহীন হয়েছেন। প্রতিবছর নদী ভাঙনের মির্জাচরে অর্ধশত পরিবার ভিটামাটি ও বহু ফসলি জমি বিলীন হয়ে যায়। মেঘনার ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে, স্কুল, মসজিদ ও বাজার। এছাড়া রায়পুরার চরসুবুদ্ধি ইউনিয়নের মহেষভেড় গ্রামেও দেখা দিয়েছে নদী ভাঙন।

অব্যাহত নদী ভাঙ্গনের ফলে বসতভিটা ও ফসলি জমি হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন এসব এলাকার মানুষ।স্থানীয়দের অভিযোগ, চাঁনপুর ইউনিয়নের তিনটি মৌজায় মেঘনা নদীতে অপরিকল্পিতভাবে বালু মহাল ইজারা দিয়েছে জেলা প্রশাসন। দীর্ঘদিন ধরে এসব বালু মহালের ইজারাদাররা মেঘনা দিনরাত সমানতালে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে নিয়মবর্হিভূতভাবে বালু উত্তোলন করছেন। ইজারাকৃত সীমানা ছাড়িয়ে যত্রতত্র ও মেঘনার তীরবর্তী এলাকা থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কারণে দেখা দিয়েছে নদী ভাঙ্গন। এসব বালু উত্তোলনে একাধিক প্রভাবশালী মহল জড়িত থাকায় স্থানীরা প্রতিবাদ করতে পারছেন না। অপরিকল্পিতভাবে ইজারা প্রদান করা তিনটি বালুমহাল এর লোকজন এলাকা ছাড়িয়ে নদী তীরবর্তী এলাকায় বালু উত্তোলনের ফলে নদী ভাঙ্গনের সৃষ্টি হলেও নজরদারি নেই স্থানীয় প্রশাসনের। এতে প্রতি বছরই নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়ে ভিটেমাটি ছাড়া হয়ে পড়ছেন অনেকে। 


চাঁনপুর ইউনিয়নের কালিকাপুর গ্রামের আজগর মিয়া বলেন, গত তিন বছরে এই গ্রামের শতাধিক বাড়িঘর নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এবার গত এক সপ্তাহে ১৮টি বাড়িঘর বিলীন হয়েছে। এখন আমাদের আর কোন সম্পদ অবশিষ্ট নেই। চাঁনপুরে মেঘনা নদীতে বালু কাটার কারণেই এই ভাঙ্গন হচ্ছে। 


ইমামদিরকান্দি গ্রামের সিদ্দিক মিয়া বলেন, আমাদের গ্রামটা তিনবার ভাঙ্গনের ফলে এখন পুরো গ্রামই বিলীন হয়ে গেছে। এখন আমরা কোথায় আশ্রয় নিবো বুঝতে পারছি না। অনেকে পাশের গ্রামের অন্যের বাড়ি ঘরে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।  


চাঁনপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দিন বলেন, ড্রেজারে মাটি কাটার কারণে কয়েকটি গ্রামের মানুষ বাড়িঘর হারিয়ে অন্যত্র গিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। সরকার নদীতে বালু মহাল ইজারা দিয়েছে, কিন্তু ইজারাদাররা মহালের সীমানা ছাড়িয়ে লোকজনের রেকর্ডকৃত (সিএস, আরএস, এসএ) জমি থেকে বালু তুলছে। এ কারণে এলাকাটি বিলীন হচ্ছে।  


চাঁনপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো: মোমেন সরকার বলেন, নদী ভাঙ্গন থেকে রক্ষা পেতে এসব বালু মহাল বন্ধের জন্য দীর্ঘ ৯ বছর ধরে আবেদন জানিয়েও কোন ফল পাওয়া যাচ্ছে না। নদী ভাঙ্গন রোধে বালু উত্তোলন বন্ধ করা, বেড়িবাধ নির্মাণ ও আশ্রয়হীনদের জেগে উঠা চরের খাস জমিতে বসবাসের ব্যবস্থাকরণের দাবী জানাচ্ছি।    

যোগাযোগ করা হলে নরসিংদীর জেলা প্রশাসক সৈয়দা ফারহানা কাউনাইন বলেন, বালু মহালের সীমানা ছাড়িয়ে বালু উত্তোলন করা হলে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। বালু তোলার কারণে যদি নদী ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে প্রয়োজনে বালু মহাল বন্ধ করে দেয়া হবে এবং গৃহহীন পরিবারগুলোর জন্য আবাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। চাঁনপুর ও চরমধুয়া ইউনিয়নে স্থায়ীভাবে নদী ভাঙ্গন ঠেকাতে একটি প্রতিরক্ষামূলক কাজ প্রকল্প একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানান তিনি। 



এই বিভাগের আরও