করোনাভাইরাস সংকট: ভালো নেই নরসিংদীর মধ্যবিত্তরাও

০৯ এপ্রিল ২০২০, ১০:২৬ এএম | আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:৪৬ পিএম


করোনাভাইরাস সংকট: ভালো নেই নরসিংদীর মধ্যবিত্তরাও

শেখ আব্দুল জলিল:
নরসিংদীতে করোনাভাইরাস সংকটে শুধুমাত্র নিম্ন আয়ের মানুষেরা নয়, অর্থ ও খাদ্য সংকটে দিনযাপন শুরু করেছেন মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজনও। লোকলজ্জা ও সামাজিক মর্যাদা হানির ভয়ে কাউকে কিছু না বললেও বর্তমানে মধ্যবিত্তদের অবস্থা নিম্ন আয়ের মানুষের চেয়েও খারাপ। করোনাভাইরাসের কারণে গৃহবন্দী ও কর্মহীন দরিদ্রদের মধ্যে কমবেশি সরকারী ও বেসরকারী সাহায্য সহযোগিতা পৌঁছলেও মধ্যবিত্তদের খোঁজ খবর রাখতে পারছে না কেউ।
জেলার বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন শ্রেণিপেশার একাধিক মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এমন চিত্র।

তারা জানান, করোনা সংকটের শুরুতে নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষেরা বেকার হয়ে পড়েন। করোনা পরিস্থিতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে স্থানীয় অর্থনীতিতে। মন্দাভাব দেখা দিয়েছে জেলার কৃষি, ক্ষুদ্র শিল্প, ব্যবসা বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে। কৃষি ও শিল্প নির্ভর নরসিংদী জেলার অর্থনীতিতে কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণির লোকজন বেকার হয়ে পড়ায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন। উৎপাদিত সবজির মূল্য না পেয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরাও। এতে কৃষি উৎপাদনেও ধস নামার আশংকা দেখা দিয়েছে।
এছাড়া করোনার বৈশি^ক সংকটের মুখে প্রবাসে থাকা লোকজনের পাঠানো রেমিট্যান্সও কমে গেছে আশংকাজনক হারে। অনেক প্রবাসী বিদেশের মাটিতে কষ্টে দিনযাপন শুরু করায় রেমিট্যান্স পাঠানো দূরের কথা উল্টো পরিবার পরিজনের নিকট সহায়তা চাচ্ছেন। অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার প্রধানদের সঞ্চিত অর্থ ফুরিয়ে যাওয়ায় সংকটে পড়েছেন তারা।

নরসিংদী শহরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বলেন, করোনা পরিস্থিতির সাথে সাথে আমার ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। পরে অন্য একটি দোকানে দৈনিক হাজিরার ভিত্তিতে চাকরি নেই। এখন সেটিও বন্ধ। স্ত্রীসহ স্কুল, কলেজ পড়ুয়া সন্তানদের নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছি। কাউকে বলতে পারছি না। নাই অজুহাতে কেউ টাকা পয়সাও ধার দিচ্ছে না।

বেলাব উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের দড়িকান্দি গ্রামের মাসুম মিয়া স্থানীয় একটি জুতা তৈরী কারখানার মালিক। তার কারখানায় কাজ করেন স্থানীয় ৫ জন শ্রমিক। এ কারখানায় তৈরী জুতা ঢাকা, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাইকারী বিক্রি করা হয়। বর্তমানে করোনা ভাইরাসের কারণে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে বন্ধ ওই জুতার কারখানাটি।
মাসুম জানান, করোনা সংকটের কারণে দুই সপ্তাহ ধরে কারখানা খুলতে পারছি না। মজুত করা জুতাও বিক্রি করতে পারছি না। কর্মচারীরা প্রতিদিনই চাপ দিচ্ছে টাকা দেয়ার জন্য। আমি নিজেও ৫ সদস্যের পরিবার নিয়ে চরম কষ্টে দিনযাপন করছি। কর্মচারীদের বেতন দিব কীভাবে। সঞ্চিত অর্থ যা ছিল সবই ফুরিয়ে গেছে। সামনের দিনগুলো কিভাবে চলবে সে চিন্তায় ঘুম আসে না।

একই উপজেলার হোসেন নগর গ্রামের কাঁচামাল ব্যবসায়ী কাওছার মিয়া। তিনি জানান, উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া তিন বিঘা জমিতে বেগুনসহ বিভিন্ন সবজি চাষ করার পাশাপাশি কাঁচামালের ব্যবসা করে জীপনযাপন করতাম। করোনার কারণে বেগুনসহ সব সবজির দাম একেবারে কমে গেছে। সবজি বিক্রির টাকায় শ্রমিক খরচ ও ভ্যান ভাড়াই দিতে পারছি না। তাই ফসল তোলা বাদ দিয়েছি। পরিবহন সংকট ও করোনার কারণে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় কাঁচামালের ব্যবসাও করতে পারছি না। বর্তমানে স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে চরম কষ্টে দিনযাপন করছি। সরকারী ও ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিদিনই সাহায্য সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে। দরিদ্র শ্রেণির একই ব্যক্তি বারবার সাহায্য সহযোগিতা পেলেও আমাদের মত মধ্যবিত্তদের পাশে কেউ দাঁড়াচ্ছে না।

আমলাব গ্রামের বাবুল মিয়া একটি হার্র্ডওয়ারী দোকানে সাতশ টাকা দৈনিক মজুরীর ভিত্তিতে কাজ করেন। তার দোকানও বন্ধ দুই সপ্তাহ ধরে। একারণে মজুরীও বন্ধ। তিনি জানান, যত সাহায্য সহযোগিতা আসে সব গরীবরাই পায় অথচ আমরা যারা মধ্যবিত্ত আমরা বলতেও পারি না, সইতেও পারি না, কষ্ট বাড়ছে।

বারৈচা বাজারের মুদী ব্যবসায়ী জাকির মিয়া বলেন, পুলিশের ভয়ে দোকান খুলতে পারি না। দোকানই আমার একমাত্র সম্বল। আমরা সাহায্য সহযোগিতাও পাই না অথচ আমাদের খরচ বেশি। বর্তমানে যে অবস্থা চলছে এভাবে জানি না আল্লাহ কতদিন রাখেন। অনেক কষ্টে আছি ভাই অনেক কষ্টে। না পারি কইতে না পারি সইতে।

বেলাব উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোসলেহ উদ্দীন খাঁন সেন্টু বলেন, মধ্যবিত্তদের অবস্থাও বর্তমানে খুবই খারাপ। তারা বড়ই অসহায়। লোক লজ্জায় কাউকেই কিছু বলতে পারেন না। তারা মধ্যবিত্ত হওয়ায় কেউ তাদের খোঁজও নেয় না। আমি মনে করি মধ্যবিত্তদেরও সরকারী বেসরকারীভাবে ত্রাণ ও সাহায্য দেয়া উচিত।

উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান শারমিন আক্তার খালেদা বলেন, আমি আশাবাদী বেকার হয়ে পড়া দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের লোকজনের পাশাপাশি মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকজনের পাশেও সরকার দাড়াবে।

যোগাযোগ করা হলে নরসিংদীর জেলা প্রশাসক সৈয়দা ফারহানা কাউনাইন বলেন, মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকজনের খোঁজখবর রাখার জন্য সরকারি নির্দেশনা রয়েছে। যদিও এমন কোন বরাদ্দ আলাদাভাবে এখনও আসেনি। এরপরও লুকিয়ে যেসব মধ্যবিত্ত পরিবার আমাদেরকে সংকট জানাচ্ছেন তাদেরকে গোপনে সহায়তা করা হচ্ছে, যাতে তারা বিব্রত না হন। আমরা সরকারি বরাদ্দে সংকট মোকাবেলার চেষ্টা করছি। এক্ষেত্রে বিত্তবানদের এগিয়ে আসার অনুরোধ জানান জেলা প্রশাসক।



এই বিভাগের আরও