বিজ্ঞানভিত্তিক ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়তে কাজ করছে সোমেন চন্দ পাঠাগার

১১ ডিসেম্বর ২০১৭, ০৮:৫১ এএম | আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:১৩ পিএম


বিজ্ঞানভিত্তিক ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়তে কাজ করছে সোমেন চন্দ পাঠাগার
শরীফ ইকবাল রাসেল বিজ্ঞানভিত্তিক ও একটি অসাম্প্রদায়িক সমাজ বির্নিমাণে কাজ করে যাচ্ছে সোমেন চন্দ পাঠাগার। নরসিংদীর পলাশ উপজেলার সুলতানপুর গুদারাঘাট এলাকায় প্রতিষ্ঠিত এই পাঠাগারটি ২১ বছরে পদার্পণ করেছে। পাঠাগারটি দীর্ঘ ২১টি বছর বইপাঠ, পাঠক সমাবেশসহ স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে বইপড়া কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া বই পড়ে বই পুরস্কার ও পড়–য়া সমাবেশের মাধ্যমেও একটি জাগরণ তৈরী করেছে। দুই শতাধিক বই আর ২০/২৫ জন পড়–য়া নিয়ে ১৯৯২ সালের ১২ নভেম্বর হাসনা হেনা পাঠাগার নামে যাত্রা শুরু এ পাঠাগারের। পরে ১৯৯৬ সালে এই পাঠাগারের নামকরণ করা হয় সোমেন চন্দ নামে। ভারতবর্ষের প্রগতিশীল এক লেখক সোমেন চন্দ। যিনি এক সময় সারােেশর মধ্যে ছোট গল্পকারদের মধ্যে সেরা লেখকের স্বীকৃতি লাভ করেন। তাঁর পৈত্রিক বাড়ি পলাশ উপজেলার বালিয়া গ্রামে। এই সোমেন চন্দ একজন প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতাও ছিলেন। মূলত তাঁর নামানুসারেই এই পাঠাগারের নামকরণ করা হয়। এই পাঠাগারের প্রধান উদ্যোক্তা ও সভাপতি শহিদুল হক সুমন জানিয়েছেন, ১৯২০ সালের ২৪ মে তৎকালীন ঢাকা জেলার টঙ্গি থানার আশুলিয়া গ্রামে তাঁর মাতুতালয়ে জন্মগ্রহণ করেন সোমেন চন্দ। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল পলাশ উপজেলার চরসিন্দুর ইউনিয়নের বালিয়া গ্রামে। তাঁর পিতার নাম নরেন্দ্র কুমার, মাতা হীরণ বালা। ১৯৩৭ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশ পায় সোমেনের প্রথম গল্প ‘শিশু তপন’। এই ১৭ বছরেই বাংলাদেশে বন্যার যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দুর্ভোগ, তা নিয়ে বাংলা সাহিত্যে প্রথম উপন্যাস ‘বন্যা’ লেখেন সোমেন। তিনি প্রগতি লেখক সংঘে যোগদান করেন এবং মার্কবাদী রাজনীতি ও সাহিত্য আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান। তিনিই বাংলা সাহিত্যে প্রথম গণসাহিত্যের উপর কাজ করেন। তাঁর আদর্শকে ধারণ করে একটি অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতেই এই পাঠাগারের নামকরণ করা হয় তাঁর নামে। পাঠাগারের সাধারণ সম্পাদক রাকিবুল হাসান জানান, পাঠাগারের শুরুটা নগণ্য হলেও আজ এর পরিধি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। এখন এই পাঠাগারে শুধু মানসম্মত বই রয়েছে প্রায় তিন হাজারেরও বেশী। আর নিয়মিত পাঠকই আছেন দুই শতাধিক আর স্কুল কলেজে রয়েছে আরো পাঁচ শতাধিক পাঠক। এই পাঠাগারে মূলত সমাজ চিন্তা, বিজ্ঞান চিন্তা, ইতিহাস ঐতিহ্য, দর্শন, অর্থনীতি, রাজনীতি, শিশু সাহিত্য বিভাগের বই-ই বেশী। এছাড়া রয়েছে বাংলা-ইংরেজী একাধিক পত্রিকা ও ডজন খানেক স্বনামধন্য ম্যাগাজিন। তিনি আরো জানান, এই পাঠাগারের মাধ্যমে চরসিন্দুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত তিন শতাধিক শিক্ষার্থীর মাঝে বইপড়া কার্যক্রম করে থাকে। এছাড়া চরসিন্দুর শহীদ স্মৃতি কলেজে প্রায় আরো দুই শতাধিক শিক্ষার্থীদের মাঝেও এই কার্যক্রম রয়েছে। প্রতি শনিবার পাঠাগারের সদস্যরা বই নিয়ে স্কুল ও কলেজের পাঠকদের হাতে বই তুলে দিচ্ছেন। সাতদিনের মধ্যে এই বই পড়া শেষে পুণরায় এগুলো ফেরত নিয়ে নতুন বই দেয়া হচ্ছে। এভাবে এক বছর অতিবাহিত হলে বছর শেষে মূল্যায়ন পরীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে পাঠক সমাবেশ করে পুরষ্কার হিসেবে আবার নতুন বই তুলে দেওয়া হয়। পাঠাগারের ৫ বছর ধরে নিয়মিত পাঠক মাহমুদুল হাসান। সে চরসিন্দুর উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। অভিমত ব্যক্ত করতে গিয়ে মাহমুদুল হাসান জানায়, আমি ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে বই পড়া শুরু করি। পাঁচ বছরে তিন বারই মূল্যায়ন পরীক্ষার মাধ্যমে উত্তীর্ণ হয়ে বই পুরষ্কার পেয়েছি। এই বই পড়ার আগে আমি অনেক কিছু থেকেই অজ্ঞ ছিলাম, কিন্তু এখন বই পড়ে আমি বিজ্ঞান, দেশের প্রকৃত ইতিহাস, অর্থনীতি ও বড় বড় মনীষীদের জীবনী সম্পর্কে জেনে নিজে কিছুটা আলোর মুখ দেখতে পারছি বলে মনে করি। তার মতোই আরেক পাঠক জাহিদ হাসান। সেও একই স্কুলের দশম শ্রেণীর বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। সে জানায়, আমার স্কুলের শিক্ষকরাও সহপাঠীরা বই পড়তে আমাকে উদ্বুদ্ধ করেন। এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর বই পড়া শুরু করি। কিছুদিন যাওয়ার পর বই পড়ার প্রতি আমার আগ্রহ তৈরী হলে নিজে থেকেই বই পড়া শুরু কির। এখন আমি বই না পড়লে ভালো লাগে না। কেন বই পড় বা বই পড়ে কী পেলে এই প্রশ্নের জবাবে জাহিদ জানায়, বিশ্বের মনীষীরা কীভাবে বড় হয়েছেন, তারা কীভাবে বাধা বিপত্তি অতিক্রম করেছেন তা বই পড়ে জানলাম। আর তাদের সাথে আমাদের দেখা করাটা অসম্ভব, তাই তাদের বই পড়ার মাঝে কথা বলে থাকি। চরসিন্দুর শহীদ স্মৃতি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী রাব্বী তার অনিভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে জানায়, যে ব্যক্তি বই পড়ে না, সে যেনো অন্ধকার রাজ্যে বাস করে। শুধু তাই নয়, বই না পড়লে এক প্রকার অন্ধ লোকের মতোই মনে হয়। আমি বই পড়েই জানতে পারি। কেননা এই বই পড়েই জানতে পারি, একটি অসাম্প্রদায়িক, মুক্ত চিন্তার সমাজ গড়তে হলে প্রগতিশীল চিন্তু চেতনার মানুষের প্রয়োজন। আর তেমনটি ছিলো সোমেন চন্দের মাঝে। তাই তিনি মৃত্যুর ৭৫ বছর পরও সাহিত্য সমাজের মানুষ তাকে স্মরণ করেন। আরো শত বছর তাকে স্মরণ করবে। তাই তার আদর্শকে বাস্তুবে রূপ ধারণ করাতে পারলে এই সমাজ পরিবর্তন সময়ের ব্যাপার। এই পাঠাগার থেকে বই নিয়ে সমাজ চিন্তুা, বিজ্ঞান চিন্তুা, রাষ্ট্রনীতি ও বিশ্বের মহামানবদের জীবনী পড়ে অনেক কিছু জানতে পেরেছি। তাই আমি মনে করি নতুন প্রজন্মকে প্রগতিশীল হিসেবে তৈরী করতে হলে বই পড়ার দিকে আকৃষ্ট করতে হবে। পাঠাগারের পাঠাগার বিষয়ক সম্পাদক প্রবাল বর্মন জানান, এই পাঠাগারটির বর্তমান অবস্থা এমন হয়েছে যে, প্রতি বছর কমপক্ষে বিশ থেকে পঁচিশ হাজার টাকার নতুন বই ক্রয় করতে হচ্ছে। কেননা তিন হাজার বই ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ফিরে ফিরে এক বছরের মধ্যে পড়া শেষ হয়ে যায়। পরবর্তিতে পড়–য়ারা নতুন বই পড়তে চায়। তাদের বই পড়ার চাহিদা নিবারণের জন্য নতুন নতুন বই সংগ্রহ করতে হয়। এই পাঠাগারের খবর শুনে স্থানীয় সাবেক সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আশরাফ খান দিলীপ, নরসিংদীর সাবেক জেলা প্রশাসক কাজী আখতার হোসেন, পলাশের সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদা আক্তার, নরসিংদী চেম্বারের পরিচালক আল-আমীন রহমান কিছু আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন। তিনি আরো জানান, পাঠকদের বছরের শেষে মূল্যায়ন পরীক্ষার মাধ্যমে পুরষ্কার হিসেবে ২০/২৫ হাজার টাকার বই উপহার দিতে হয়। এই বিশাল অঙ্কের অর্থ সংগ্রহ করতে হয় পাঠাগারের সদস্যদের চাঁদা আর কার্যকরী কমিটির সদস্যদের বিশেষ চাঁদার টাকায়। কিছু সহযোগিতার জন্য জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রে একটি রেজিষ্ট্রেশনও করা হয়েছে। পাঠাগারের অর্থ সম্পাদক রিপন চক্রবর্তী জানান, সমাজে অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ প্রগতিশীল চিন্তা চেতনার মানবিক গুনাবলি সম্পন্ন ব্যক্তি তৈরী করাই এই পাঠাগের লক্ষ্য। আর সেই চিন্তু চেতনা থেকেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। পাঠাগারের সদস্যদের আশা এই পাঠাগারের মাধ্যমে আদর্শগত বিজ্ঞান চিন্তুার মানবিক গুনাবলির মানুষ তৈরী হবে। এই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে সোমেন চন্দ পাঠাগার। এই পাঠাগারের ২১ বছর পূর্তি উপলক্ষে ১১ ডিসেম্বর সোমবার আয়োজন করা হবে বর্ণাঢ্য র‌্যালী, আলোচনা সভা, পড়–য়া সমাবেশ, নাটক ও পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের।