আবাসিক এলাকায় পোল্ট্রি খামার, বিষ্ঠার দুর্গন্ধে টিকতে পারছেন না এলাকাবাসী

১৬ আগস্ট ২০২৩, ০৬:৩৯ পিএম | আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৪৪ এএম


আবাসিক এলাকায় পোল্ট্রি খামার, বিষ্ঠার দুর্গন্ধে টিকতে পারছেন না এলাকাবাসী

নিজস্ব প্রতিবেদক:

নরসিংদীতে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে আবাসিক এলাকায় গড়ে উঠা পোল্ট্রি খামারের বিষ্ঠার দুর্গন্ধে টিকতে পারছেন না এলাকাবাসী। নরসিংদী পৌর শহরের বীরপুর এলাকায় গড়ে উঠা একটি পোল্ট্রি খামারসহ বিভিন্ন এলাকার খামারীদের বিরুদ্ধে পরিবেশ দূষণের অভিযোগ করছেন ভুক্তভোগীরা। সংশ্লিষ্ট বিভাগে অভিযোগ করেও প্রতিকার পাচ্ছেন না এলাকাবাসী। এমন কী খামারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগকারীদের মারধর সহ নানা ভাবে হয়রানির অভিযোগও উঠেছে।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, অধিকাংশ খামারী পরিবেশের নিয়ম নীতি উপেক্ষা করে লোকালয়ে খামার স্থাপন করেছেন। এতে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে পরিবেশ নষ্ট হওয়ায় খামারের পাশে বসবাসকারী লোকজন স্বাস্থ্যগত নানা সমস্যায় ভুগছেন।

নরসিংদীতে জেলা প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, নরসিংদীতে ডিম উৎপাদনকারী পোল্ট্রি খামারের সংখ্যা ১ হাজার ৩২০ টি, যেখানে মুরগীর সংখ্যা প্রায় ২১.৬৫ লাখ। এতে প্রতি বছর ৪৩ কোটি ডিম উৎপাদিত হয়। নরসিংদী জেলা প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরে সোমবার (১৪ আগস্ট) পর্যন্ত ২০ টিরও বেশি খামারের বিরুদ্ধে পরিবেশ দূষণের লিখিত অভিযোগের তদন্ত চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছে দপ্তরটি।

প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তর বলছে, বায়োগ্যাস প্লান্ট ব্যবহার স্থাপন করলে খামার করার অনুমোদন দেয়া হয়ে থাকে। অতিরিক্ত লাভের আশায় যারা মুরগীর বিষ্ঠা মাছের খাবারের জন্য জমা করে রেখে দেন তাদের খামার হতে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।

পরিবেশ অধিদপ্তর ও প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরে দেয়া লিখিত অভিযোগ থেকে জানা গেছে,  এলাকাবাসীর বাঁধার পরও ২০১৮ সালে নরসিংদী পৌর এলাকার ঘনবসতিপূর্ণ বীরপুরে ডিম উৎপাদনকারী একটি পোল্ট্রি খামার স্থাপন করেন ওই এলাকার আবসার উদ্দিনের ছেলে সালাউদ্দিন অরফে সেলিম (৪৫)। পরে এটি সম্প্রসারণ করে ৩ টি শেডে রুপান্তর করা হয় এবং বর্তমানে প্রায় ৮ হাজার মুরগী রয়েছে খামারটিতে। ডিমের পাশাপাশি মাছের জন্য বিষ্ঠা জমিয়ে রেখে মাছ উৎপাদনকারী বিভিন্ন খামারে বিক্রি করা হচ্ছে এখান থেকে। ফলে বিষ্ঠা জমিয়ে রাখায় দুর্গন্ধ আরও প্রকট আকার ধারণ করায় এলাকার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।

এ খামারটির বিরুদ্ধে গত ১২ মার্চ নরসিংদী পরিবেশ অধিদপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী এলাকাবাসী। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে অভিযোগ প্রত্যাহার না করায় গত ১৯ জুলাই অভিযোগকারীদের মারধর করা হয়। এ বিষয়েও থানায় লিখিত অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা।

বীরপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, তিনজন শ্রমিক ড্রামে করে মুরগির বিষ্ঠা ভ্যানে তুলছেন। মাছের খাবারের জন্য প্রতিদিন ১০ টি ড্রামে করে প্রায় ৪৫০ কেজি বিষ্ঠা অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয় বলে স্বীকার করে শ্রমিকরা। খামারটির উত্তর পাশের দুটি বাড়ী প্রায় বসবাসের অনুপযোগী অবস্থায় পড়ে আছে। বাড়ীর মালিক ঘর ছেড়েছেন দুই বছর আগে। আশে পাশের অন্তত ১৫-২০ টি বাড়ীতে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। অভিযোগের প্রতিকার না পাওয়ায় এবং দুর্গন্ধের কারণে বাধ্য হয়ে ফার্মের পাশের দুটি পরিবার অন্যত্র বসবাস করছেন। নিয়ম অনুযায়ী একটি মুরগির খামার স্থাপনের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি ও প্রাণিসম্পদ কার্যালয় থেকে রেজিস্ট্রেশনভুক্ত হতে হয়। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা এবং জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি হয় এমন স্থানে খামার স্থাপন করা যাবে না। কিন্তু এসবের তোয়াক্কা না করেই চলছে খামারটি।

ভুক্তভোগী শাহিদা আক্তার বলেন, মুরগীর বিষ্ঠার দুর্গন্ধের জন্য বসবাসের অযোগ্য হওয়ায় আমি ও আমার প্রতিবেশী হোসেন আলী খান বাড়ী ছেড়ে অন্যত্র বসবাস করতে বাধ্য হয়েছি। স্থানীয়ভাবে একাধিক সালিশ হলেও খামার মালিক এসব সালিশের রায়কে তোয়াক্কা না করে গায়ের জোরে একের পর এক খামার গড়ে তুলছেন।

খামারের পাশের বাসিন্দা ভুক্তভোগী শিউলি বেগম বলেন, প্রতিদিন দুপুর থেকে পরের দিন দুপুর পর্যন্ত বিষ্ঠা জমিয়ে রাখায় দুর্গন্ধ প্রকট হয়। তিনি পরিবেশ অধিদপ্তরে অভিযোগ করায় তাকে মারধরসহ বিভিন্নভাবে হেনস্থা করা হয়েছে। পরে তিনি গত ১০ জুলাই থানায় অভিযোগ করেন।

নরসিংদী সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল কাশেম ভুইয়া বলেন, "ভুক্তভোগীর বাড়ীর পাশের খামার থেকে প্রচণ্ড দুর্ঘন্ধ ছড়িয়ে পড়ার প্রমাণ পেয়েছি। তবে, আমাদের হাতে ভ্রাম্যমান আদালত না থাকায় খামারটি তুলে দিতে পারছি না। ভুক্তভোগীর লিখিত অভিযোগটি আদালতে প্রেরণ করা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।"

 

এদিকে গত ১১ মে শিবপুর উপজেলার পাড়াতলা শামীম পোল্ট্রি ফার্মের বিরুদ্ধে উপজেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরে অভিযোগ করেন স্থানীয় আশরাফুল ইসলাম ও তার প্রতিবেশিরা। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তর খামারটি সরিয়ে নিতে বললেও তারা সরিয়ে নেননি। পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতার জন্য শামীম খামারটি সরিয়ে নিচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী আশরাফুল।

এ বিষয়ে জানতে অভিযুক্ত শামীমকে একাধিকবার কল দেয়া হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।

এসব খামারের মতই আরও জেলার ১৮ টি খামারের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা হয়েছে নরসিংদী জেলা প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরে।

নরসিংদীর অতিরিক্ত প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডা. ফারুক আহমেদ বলেন, "নরসিংদী জেলায় ২০ টির বেশি খামারের বিরুদ্ধে পরিবেশ দূষণের অভিযোগ রয়েছে। আমরা তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবো। আমরা শুধু উৎপাদনকে প্রাধান্য দিচ্ছি না, পাশাপাশি জনস্বাস্থ্যকেও প্রাধান্য দিচ্ছি।

নরসিংদী পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শেখ নাজমুল হুদা বলেন, অভিযোগ পাওয়ার পর তদন্তে সত্যতা পাওয়ায় এসব খামার বন্ধের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। অভিযোগের বিষয়ে খামার মালিকদের জবাব সন্তুষ্টজনক না হওয়ায় গত জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে ঢাকার এনফোর্সমেন্ট শাখায় অভিযোগ প্রেরণ করা হয়েছে এবং লাইসেন্স নবায়ন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ঢাকা থেকে সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত কিছুই করতে পারবো না। আর শামীম পোল্ট্রি খামারের বিরুদ্ধে ২০ দিনের মধ্যে খামার সরিয়ে নেয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তারা স্থানীয়ভাবে মিমাংসা করে নিয়েছেন। আমাদেরকে তারা আর কিছু জানাননি। আমরা পরিবেশ দূষণের অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছি।



এই বিভাগের আরও