নরসিংদীতে অভিনব প্রতারণায় ১০ কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা বিকাশ এজেন্ট

১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৪:৫১ পিএম | আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:৪৫ এএম


নরসিংদীতে অভিনব প্রতারণায় ১০ কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা বিকাশ এজেন্ট
লাপাত্তা আনিকুল ইসলাম

নিজস্ব প্রতিবেদক:

নরসিংদীতে বাড়তি লাভের লোভ দেখিয়ে অভিনব কায়দায় প্রতারণা করে প্রায় ১০ কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা আনিকুল ইসলাম নামের একজন মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশ এজেন্ট। বিকাশে অতিরিক্ত লাভের ফাঁদে ফেলে টাকা নিয়ে আনিকুল ইসলাম দুবাই চলে গেছেন বলেও জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। এ ঘটনায় আনিকুল ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে গত মঙ্গলবার নরসিংদী সদর থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।

অভিযুক্ত বিকাশ এজেন্ট আনিকুল ইসলাম (২৩) নরসিংদী পৌর শহরের ব্রাহ্মন্দী এলাকার তৌহিদা এন্টারপ্রাইজের মালিক। এছাড়া নরসিংদী সদর উপজেলার আলোকবালী ইউনিয়নের সংরক্ষিত ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য ও ইউনিয়ন আ’লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আরিফা ইয়াসমিন মুন্নির (৪২) ছেলে।

নরসিংদী জেলা প্রশাসন ঘটনাটি অবহিত হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভায় এ নিয়ে আলোচনা হয়। বিষয়টি পুলিশের বিশেষ শাখাকে ছায়া তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়। প্রাথমিকভাবে পুলিশের ছায়া তদন্তে অভিনব প্রতারণার সত্যতা মিলেছে। সরেজমিন ঘুরে ৫০ জন ভুক্তভোগীর কাছ থেকে বিভিন্ন অংকের প্রায় ১০ কোটি হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

আল আমিন নামের একজন ভুক্তভোগী বলেন, "আমি একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষ। আয় রোজগার না করতে পেরে আমার একটি নাম্বারের বিকাশ এজেন্টের আয় থেকে পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করতাম। বাড়তি লাভের আশায় বিকাষ কোম্পানীর কাছ থেকে ক্যাশ আউট না করে আনিকুলের এজেন্ট থেকে ক্যাশ আউট করতাম। বিকাশ কোম্পানী ক্যাশ আউটের জন্য এজেন্টকে দিতো লাখে ৫ শত, আনিকুল দিতো ৩ থেকে ৪ হাজার। এমন লোভে অনেক এজেন্ট তাঁর কাছে টাকা ক্যাশ আউটের জন্য যেতো।

তিনি আরও বলেন, অতিরিক্ত লাভের আশায় আনিকুলকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা দিয়েছিলাম। আমার পাশের বাসার ছেলে আনিকুল পুঁজি গায়েব করে পালিয়ে গেছে। অভিযুক্তের মায়ের কাছে টাকা চাইলে উল্টো হুমকি দেয়। এখন না খেয়ে মরার মত অবস্থা হয়েছে। মঙ্গলবার আমরা ৭ জন ভুক্তভোগী একত্রিত হয়ে থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছি, যাদের মোট টাকার পরিমাণ ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা। "

আলোকবালী ইউনিয়নের বাখরনগর গ্রামের ফাইভ জি স্টোরের মালিক ভুক্তভোগী সোহান আলী বলেন, "আনিকুলের বিকাশ এজেন্ট থেকে প্রতি এক লাখ টাকায় ক্যাশ আউটের জন্য অতিরিক্ত ৩ হাজার টাকা করে দেয়া হতো। ৩ মাস ধরে আমাদেরকে এভাবে লভ্যাংশ দিয়ে আসছিল এবং একই এলাকার ছেলে হিসেবে তার প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস তৈরি হয়। কিন্তু গত ১৫ দিন ধরে বিভিন্ন অজুহাতে কাউকে টাকা না দিয়ে সুযোগ বুঝে সকল টাকা আটক করে এবং কাউকে পরিশোধ না করে এলাকা থেকে  গত সপ্তাহে পালিয়ে গেছে।"

তিনি আরও বলেন, "তার পরিবারকে এঘটনা জানানো হলে উল্টো আমাদেরকে অভিযুক্ত আনিকুলকে গুম করেছি বলে হুমকি দেয়। তার পরিবার এলাকায় প্রভাবশালী হওয়ায় অভিযোগ করেও কোনো ফল পাচ্ছি না। ব্যবসার সকল টাকা হারিয়ে, না পারছি পরিবারকে বুঝাতে, না পারছি টাকা আদায় করে ব্যবসা চালিয়ে যেতে।"

একই এলাকার ভুক্তভোগী খলিল উল্লাহ স্টোরের মালিক খলিল উল্লাহ বলেন, বিকাশের মাধ্যমে ১০-১২ দিন আগে সাড়ে ১৫ লাখ টাকা নিয়েছে। আনিকুলের এজেন্ট নাম্বারে টাকা পাঠানোর ডকুমেন্টও আছে। আনিকুলের মায়ের আশ্বাসে তার সাথে ব্যবসা শুরু করেছিলাম। এখন টাকা, সম্মান দুটোই শেষ। এখন মানসিকভাবে ও অর্থনৈতিকভাবে চরম খারাপ অবস্থার মধ্যে পতিত হয়েছি। আমরা টাকা ফেরত চাই।"

আলোকবালী ইউপি চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন সরকার দীপু বলেন, " অতিরিক্ত লাভ দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নেয়ার একাধিক অভিযোগের বিষয়ে আমি অবগত। থানায়ও লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। অভিযুক্ত আনিকুল বা তার পরিবারের দৃশ্যমান কোন আয় নেই। কিন্তু গত দুই মাসে অন্তত দুই কোটি টাকা ব্যয় করে সদর উপজেলার সংগীতা ও বাসাইল এলাকায় দুটি বাড়ী কিনেছেন। ইতিপূর্বে তার মা বাবার নামেও বিভিন্ন ধরনের অপরাধের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।

অভিযুক্ত আনিকুল ইসলামের বাবা মাইনউদ্দিন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, "আমার ছেলে কারো কাছ থেকে কোনো টাকা নেয়নি। আমার ছেলেকেও গত কয়েকদিন ধরে খোঁজে পাচ্ছি না। নিখোঁজের ঘটনায় নরসিংদী সদর থানায় সাধারণ ডায়েরী করেছি। আমরা শহরে কোনো বাড়ী কিনে থাকলে, সরকার তা খোঁজে বের করে বাজেয়াপ্ত করুক।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ছায়া তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, "আমি তদন্তে প্রায় ৫০ জন ভুক্তভোগীর নাম পেয়েছি, যাদের টাকার পরিমাণ ১০ কোটিও বেশি। তদন্ত প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জমা দেয়া হবে।

তিনি আরও জানান, বিকাশ কর্তৃপক্ষ প্রতি এক লাখ টাকায় বিকাশ এজেন্টদের ৫ শত টাকা লভ্যাংশ প্রদান করে কিন্তু আনিকুল প্রতি এক লাখ টাকার বিপরীতে ৩-৪ হাজার টাকা লভ্যাংশ প্রদান করতো। ভুক্তভোগীরা সবাই আনিকুলের এলাকার হওয়ায় সহজে আনিকুলকে বিশ্বাস করে তার এজেন্ট নাম্বার থেকে উত্তোলন করতন। গত ৩-৪ মাস ধরে নিয়মিত টাকা পরিশোধ করে বিশ্বস্থতা অর্জন করে সুযোগ বুঝে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।"

নরসিংদী সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. তানভীর আহমেদ বলেন, "ভুক্তভোগীদের মধ্যে ৭ জনের কাছ থেকে লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। তবে ভুক্তভোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। প্রাথমিক তদন্তে বিকাশে অতিরিক্ত লাভের লোভ দেখিয়ে সরল বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে ভুক্তভোগীদের টাকা আনিকুল আত্মসাৎ করেছে। আমরা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি। ভুক্তভোগীদের কেউ হুমকি দিলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।"

নরসিংদীর জেলা প্রসাশক ড. বদিউল আলম বলেন, "টাকা আত্মসাতের ঘটনাটি ভুক্তভোগীদের অভিযোগ ছাড়াও ছায়া তদন্ত করা হচ্ছে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে টাকার সঠিক পরিমান এখনও জানা যায়নি।

জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করতে অনিচ্ছুক ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের ঢাকা অফিসের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, "আনিকুলের পাসপোর্ট এর তথ্য অনুযায়ী তিনি গত ১০ ফেব্রুয়ারি হযরত শাহজালাল আর্ন্তজাতিক বিমান বন্দর থেকে দুবাইয়ের শারজাই বিমানবন্দরে চলে গেছেন।"

উল্লেখ্য, এর আগে গত ২৩ জানুয়ারি নরসিংদীর রায়পুরার আলগী বাজারের ডাচ বাংলার এজেন্ট শাখা থেকে প্রায় ৪৫-৫০ জন গ্রাহকদের প্রায় ১০ কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা এজেন্ট উদ্যোক্তা। এছাড়াও গত ১০ বছরে নরসিংদী থেকে আরডিবি, শাহ সুলতান মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি, সোনালী ইন্সুরেন্স, সোয়াল ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি, সন্ধ্যানী লাইফ ইন্সুরেন্স , পিডিবি ও মধুমতি ইন্সুরেন্স সহ নামে বেনামে আরও একাধিক সংস্থা ও ব্যক্তি কর্তৃক একাধিক অর্থ জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। এ নিয়ে বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় খবর প্রকাশিত হয়েছে।



এই বিভাগের আরও