নরসিংদীতে দুই দশকে বিলুপ্ত ১২ টিরও অধিক সিনেমা হল

২১ জুলাই ২০২০, ০৫:৫৪ পিএম | আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৫৭ পিএম


নরসিংদীতে দুই দশকে বিলুপ্ত ১২ টিরও অধিক সিনেমা হল

রাকিবুল ইসলাম:
ফাইট, এ্যাকশান, সংলাপ, হাঁসি, কান্না, বাংলা ছায়াছবির গানের ফাঁকে ফাঁকে বলা হতো, আসিতেছে। কালের বিবর্তনে এখন আর সেই আওয়াজ করা বাংলা ছায়াছবির মাইকিং শোনা যায় না। বিদ্যুেেতর খুটিতে কিংবা বিভিন্ন দেয়ালে লাগানো বাংলা ছবির পোস্টারও চোখে পড়ে না আর।

নরসিংদীর বিভিন্ন উপজেলা ও হাট-বাজারে বিভিন্ন সময় গড়ে ওঠা প্রায় সবগুলো সিনেমা হল এখন বিলুপ্তির পথে। এই জেলা থেকে বিগত দুই দশকে বিলুপ্ত হয়েছে ১২ টির অধিক সিনেমা হল। আশি ও নব্বইয়ের দশকে সংগীতা, মিতালী, সুরভী, পিপাসা, সাথী, রাজমনিহার, রূপসী, মমতা, সোহাগ, রাজ, রুনা, ছন্দা ও জলসা সিনেমা হলসহ এক সময় নরসিংদীর ছয় উপজেলায় ১৮টি সিনেমা হল গড়ে ওঠলেও এখন টিকে আছে মাত্র ৫ টি।

রায়পুরার হাসনাবাদের ছন্দা, নরসিংদী সদরের পাঁচদোনা মোড়ের ঝংকার, মাধবদীর মমতা এবং ঘোড়াশালের সোহাগ, চালাকচরের রুনা। টিকে থাকা এই সিনেমাহলগুলোও চলছে খুড়িয়ে খুড়িয়ে। অব্যাহত লোকসান, নকল সিনেমা, অশ্লীলতা, পাইরেসি, ভারতীয় সিরিয়ালের প্রভাব, স্যাটেলাইট ব্যবসার দৌরাত্ম্য ও অনলাইন আসক্তি ইত্যাদি কারণে দর্শক হারাচ্ছে এই হলগুলো। এমন আরও নানা কারণে দর্শক সংকটে পড়ে লোকসান গুনছেন হল মালিকরা। ফলে অনেকটা বাধ্য হয়েই একের পর এক সিনেমা হল বন্ধ করে দিচ্ছেন তারা।

হাসনাবাদের ’’ছন্দা” সিনেমা হল কর্তৃপক্ষ জানায়, বর্তমানে এই বিনোদন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অবস্থা খুবই খারাপ। আগের দিনের তুলনায় এখন আর হলে এসে সিনেমা দেখার দর্শক নেই বললেই চলে। যার ফলে কমে গেছে টিকিট বিক্রি এবং কর্মচারীদের বেতন দিতে হচ্ছে কোনোরকমে। প্রতিমাসেই গুনতে হচ্ছে লোকসান।

পাঁচদোনা মোড়ের ঝংকার সিনেমা হলে সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এই বিনোদন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটির অবস্থা খুবই মন্দা। সিনেমা হলে এবং তার আশপাশের অবস্থা একেবারেই দর্শক শূন্য। স¦াভাবিক দিনগুলোতে হলের ভেতর মাত্র আট থেকে দশজন দর্শক দিয়েই চালাতে হচ্ছে একেকটি শো। একই চিত্র চোখে পড়ে চলমান থাকা বাকি হলগুলোতেও।

প্রেক্ষাগৃহ মলিকদের বক্তব্য, শুধু দেশীয় চলচ্চিত্র দিয়ে এই মুহূর্তে সিনেমা হল বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়। কারণ ঘরে বসে স্যাটেলাইট চ্যানেলে ভারতীয় ছবিগুলো দেখছে দর্শক, কিন্তু প্রেক্ষাগৃহে তা প্রদর্শন করা যাচ্ছে না। এ কারণে প্রেক্ষাগৃহে দর্শক কমে গেছে।

হলের একসময়কার নিয়মিত দর্শক ও সংস্কৃতিকর্মী নূর মোহাম্মন খান স্বপন প্রকাশ করেছেন ভিন্নমত। তিনি মনে করেন, এ শিল্পে ভালো শিল্পীর সংকট চলছে। এ ছাড়া ছবির মানও খুব নিম্নমানের। ছবির মান ও শিল্পীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে দর্শকরা সিনেমা হলে আসতে উদ্বুদ্ধ হতো বলে মনে করেন তিনি।

এদিকে, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, আধুনিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান না থাকা, চলচ্চিত্র বিষয়ে দক্ষ ও অভিজ্ঞ লোক ও ভালো চলচ্চিত্রের অভাব, এসব কারণে বড় পর্দায় সিনেমা দেখার প্রতি দর্শকের আগ্রহ কমে গেছে। একই সঙ্গে ঘরে ঘরে স্যাটেলাইট টিভি আর ভিডিও পাইরেসির কারণে সিনেমা হলের কদর কমছে বলে মনে করছেন সচেতন নাগরিকরা।

অধ্যাপক ও সংস্কৃতিকর্মী নাজমুল আলম সোহাগ বলেন, 'ব্যাপারটা দুঃখজনক কিন্তু অনিবার্য। কারণ সরকার বা দায়িত্বশীল লোকদের পক্ষ থেকে সিনেমা হল টিকিয়ে রাখার কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এমন কি লোক দেখানো কোনো কার্যক্রমও চোখে পড়েনি। চলচ্চিত্র এমন একটি গণমাধ্যম যাকে গণের কথা ভাবতে হয়। আর এতেই সরকারের সঙ্গে বেঁধে যায় সংশ্লিষ্টদের। অন্যদিকে সমাজের প্রতিক্রিয়াশীলরাও তৎপর চলচ্চিত্রের বিরুদ্ধে। তো সরকার ও প্রতিক্রিয়াশীলদের যৌথ আঁতাতে চলচ্চিত্র থেমে যেতে বসেছে। আর এই ষড়যন্ত্রের চক্রেই সিনেমা হলের আজকের এই বেহাল অবস্থা।'

নরসিংদী সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারি অধ্যাপক নাদিরা ইয়াসমিন উপজেলা ও প্রত্যেক ইউনিয়নে মানসম্পন্ন সিনেমা হল নির্মাণের দাবি জানিয়ে বলেন, মানুষ মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণের পরেই মনের খোরাক তথা বিনোদনের জন্য ছুটে। সারা পৃথিবীতেই চলচ্চিত্র শুধু একটি গুরুত্বপূর্ণ বিনোদনের মাধ্যমই না, একটি গুরুত্বপূর্ণ গণমাধ্যমও। দেশের অর্থনীতি বিকাশের ফলে মানুষের হাতে আগের তুলনায় প্রচুর অর্থ এসেছে। অথচ বিগত বছরগুলোতে চলচ্চিত্র শিল্প ধ্বংসের সাথে সাথে একের পর এক দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সিনেমা হলগুলোও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আজকের গ্রামের একজন দর্শকও পৃথিবীর নানা প্রান্তের সিনেমা দেখার সুযোগ পাচ্ছে, খোঁজ খবর রাখতে পারছে। তাই বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানের সিনেমা নির্মাণের পাশাপাশি বিদেশি ভাষার নির্মিত সিনেমা হলগুলোতে প্রদর্শনের সুযোগ করে দিতে হবে যাতে প্রতিযোগিতা তৈরি হয়। সেই সাথে শুধু জেলা, উপজেলা নয়, প্রত্যেক ইউনিয়নে অন্তত একটি করে মানসম্পন্ন সিনেমা হল নির্মাণের দাবি জানাই।


বিভাগ : বিনোদন


এই বিভাগের আরও